২০২৬ সালে পবিত্র হজ পালনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে সৌদি আরব। এতে ১২ অক্টোবরের মধ্যে হজে যেতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এরপর ৯ নভেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের দ্বিপক্ষীয় হজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তবে এবার মেডিকেল ফিটনেস (শারীরিক সুস্থতা) ছাড়া কেউ হজে অংশ নিতে পারবেন না। এর মধ্যে হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনি জটিলতা, লিভার সিরোসিস, নিউরোলজিক্যাল বা মানসিক সমস্যা, কেমোথেরাপি/রেডিওথেরাপি নেওয়া ক্যানসার এবং ঝুঁকিপূর্ণ অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ জটিল রোগে আক্রান্তদের হজ পালনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সৌদি আরব। সম্প্রতি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এই ধরনের একটি রোডম্যাপ হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব), হজ এজেন্সি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পাঠিয়েছে।
সৌদি আরবের বরাত দিয়ে রোডম্যাপে বলা হয়েছে, হজ এজেন্সিগুলোর আগামী বছর হজে সর্বোচ্চ দুটি সার্ভিস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করার সুযোগ থাকবে। সব ধরনের চুক্তি এবং অর্থ প্রদান ‘নুসুক মাসার’ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেই সম্পন্ন করতে হবে। এর বাইরে কোনো অর্থ দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকবে। কুরবানির অর্থও এই প্ল্যাটফর্মে জমা দিতে হবে। এছাড়া হজযাত্রীদের খাবারসংক্রান্ত চুক্তি করতে হবে সৌদি ক্যাটারিং কোম্পানির সঙ্গে। একই সঙ্গে তাঁবু, সেবা প্যাকেজ এবং পরিবহণ খরচ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশে জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা হজের নিবন্ধন করতে পারবেন না বলে জানানো হয়।
আরও জানা যায়, ১০ জুলাই হজ কোটা ঘোষণা করবে সৌদি সরকার। ২৬ জুলাই থেকে ‘নুসুক মাসার’ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্যাম্পসংক্রান্ত তথ্য পর্যবেক্ষণ ও অর্থ স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে। ৯ থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত চলতি হজ মৌসুমের ব্যবহৃত ক্যাম্পগুলো আগামী হজ মৌসুমের জন্য পুনর্ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। এছাড়া প্যাকেজ, আবাসন, পরিবহণ চুক্তি, এয়ারলাইন্স নির্ধারণসহ ফ্লাইট সূচি চূড়ান্ত করতে হবে ২৪ আগস্টের মধ্যে। একই সঙ্গে হজযাত্রীদের তথ্য নুসুক মাসারে আপলোড এবং গ্রুপ গঠন শুরু করতে হবে। ২১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁবু ভাড়া ও মাশায়ের প্যাকেজ বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ পাঠাতে হবে। ৪ জানুয়ারির মধ্যে সেবা সংস্থার সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি এবং ফ্লাইট সূচি নির্ধারণ করতে হবে। ২০ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে মক্কা-মদিনার হোটেল ও পরিবহণসংক্রান্ত অর্থ স্থানান্তর প্রক্রিয়া, যা চূড়ান্ত করতে হবে ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। হজযাত্রীদের ভিসা দেওয়া শুরু হবে ৮ ফেব্রুয়ারি এবং চলবে ২০ মার্চ পর্যন্ত। হজযাত্রীদের সৌদি আরবে যাত্রা শুরু হবে ১৮ এপ্রিল।
এ বিষয়ে হজ অধিশাখার যুগ্ম সচিব ড. মো. মঞ্জুরুল হক বলেন, সৌদি সরকারের নির্দেশনা আমরা যথাযথ অনুসরণ করব। হজের প্রাক-নিবন্ধন করার আগে সিভিল সার্জন কর্মকর্তার কর্তৃক শারীরিক সুস্থতার সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অবহিত করব।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মোশতাক হোসেন বলেন, জটিল রোগাক্রান্তদের হজে যাওয়া উচিত নয়। মৃত্যুর ঝুঁকি কমানোর জন্য সৌদি সরকার এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি সৌদি নির্দেশনা অনুযায়ী হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনি জটিলতা, লিভার সিরোসিস, নিউরোলজি বা স্নায়বিক সমস্যা, কেমোথেরাপি/রেডিওথেরাপি নেওয়া ক্যানসার আক্রান্তদের কারও যদি প্রাথমিক স্টেজে বা মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে, সে ক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ড তাদের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারে। যেটি নিয়ে তিনি হজ পালন করতে পারবেন।
হাবের মহাসচিব ফরিদ আহমেদ মজুমদার বলেন, সৌদি আরব হজের রোডম্যাপ ঘোষণা করলেও অনেক সময় তারা এসব সিদ্ধান্তে অটল থাকে না। এর ফলে বাংলাদেশি হজ এজেন্সিদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। চড়া দামে বুকিং করতে হয় হোটেলসহ নানা সার্ভিস। এছাড়া হজযাত্রীদের খাবারসংক্রান্ত চুক্তি সৌদি ক্যাটারিং কোম্পানির সঙ্গে করা বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশিরা সৌদি আরবের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত নন। অনেক সময় তাদের খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ন। ফলে সৌদি আরবের অনেক সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হয়।
হজ পোর্টাল সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছর হজের প্রাক-নিবন্ধনকারী রয়েছেন ৩৩ হাজার ৫২৭ জন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন মাত্র ৬৬১ জন। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন ৩২ হাজার ৮৬৬ জন। যদিও বিগত কয়েক বছর ধরে হজের কোটা পূরণ করতে পারেনি ধর্ম মন্ত্রণালয়। সৌদি আরবের নানা নিষেধাজ্ঞার কারণে সামনে এই কোটা পূরণ করা যাবে কি-না তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছর বিশ্বের ১৭১টি দেশের ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ২৩০ জন হজ পালন করেছেন। এর মধ্যে বিদেশি হাজির সংখ্যা ১৫ লাখ ৬ হাজার ৫৭৬ জন। আর সৌদি আরবের হাজি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৫৪ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশি হাজির সংখ্যা ৮৭ হাজার ১৫৭।
হজযাত্রীর কোটা না বাড়ানোর অনুরোধ ধর্ম উপদেষ্টার : সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে গত বছরই জানানো হয়েছে, ২০২৬ সালে হজ এজেন্সিপ্রতি হজযাত্রীর ন্যূনতম কোটা হবে দুই হাজার জন। তবে হজযাত্রীর কোটা না বাড়িয়ে এক হাজারই বহাল রাখতে সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেছেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। শুক্রবার জেদ্দায় হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ে সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মিনিস্টার ড. আল হাসান ইয়াহিয়া আল মানাখারার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি এ অনুরোধ জানান। ২০২৫ সালে সুশৃঙ্খল ও সাবলীল হজ ব্যবস্থাপনার জন্য ধর্ম উপদেষ্টা সৌদি সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অননুমোদিত হজ পালন বন্ধকরণ, হাজিদের যথাসময়ে নুসুক কার্ড সরবরাহ, মাশায়ের এলাকায় ঝামেলাহীন পরিবহণ সেবা ও নিবিড় স্বাস্থ্যসেবা এবং মৃত্যুহার হ্রাসে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সৌদি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ধর্ম উপদেষ্টা ২০২৬ সালের হজ ব্যবস্থাপনাকে সহজ ও মসৃণ করার ক্ষেত্রে কতিপয় পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তিনি নুসুক মাসার ড্যাশবোর্ডকে তথ্যসমৃদ্ধ করা এবং এ তথ্য পরিবীক্ষণ ও যাচাইয়ের ব্যবস্থা রাখার অনুরোধ জানান। তিনি মক্কা রুট ইনিশিয়েটিভসের মাধ্যমে হাজিদের ল্যাগেজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরএফআইডি ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা, মাশায়ের এলাকায় টয়লেট সুবিধা বৃদ্ধি ও পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং মিনা ও আরাফাতের তাঁবুতে বেডের সাইজ বাড়ানোর জন্য সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেন। এছাড়া হজের আবশ্যিক খরচ অগ্রিম ঘোষণা দেওয়া এবং হজযাত্রী পরিবহণে দুই দেশের জাতীয় ক্যারিয়ার বিমান বাংলাদেশ ও সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি তৃতীয় ক্যারিয়ার চালু করার বিষয়ে সৌদি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।
ডেপুটি মিনিস্টার ড. আল হাসান বাংলাদেশের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলো মনোযোগ সহকারে শোনেন এবং তা বিবেচনা করার আশ্বাস দেন। তিনি বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনাকে আরও উন্নত ও রোডম্যাপ অনুসারে সব কার্যক্রম যথাসময়ে সম্পন্ন করার অনুরোধ জানান।
এ সময় ধর্ম সচিব একেএম আফতাব হোসেন প্রামাণিক, কাউন্সিলর (হজ) মো. জহিরুল ইসলাম, কনসাল (হজ) মো. আসলাম উদ্দিন ও সচিবের একান্ত সচিব মো. কামরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।