ফেনীতে গত বছরের ব্যাপক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই এ বছরও টানা বর্ষণে প্লাবিত হয়েছে জেলাটি। গত ৮ জুলাই থেকে টানা বৃষ্টি এবং ভারতের ত্রিপুরা থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদী উপচে প্লাবিত হয় পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঞা ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। আট দিন পর জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বন্যার নতুন ক্ষত। সঙ্গে শুরু হয়েছে বন্যা-পরবর্তী ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে ক্ষতিগ্রস্তদের সংগ্রাম।
ফেনীর পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের উত্তর শালধর গ্রামের মুহুরী নদীপাড়ের বাসিন্দা সুনীল কুমার শীলের স্ত্রী প্রতিমা রানী শীল। গতকাল মঙ্গলবার তিনি জানান, বন্যায় মাথা গোঁজার ঠাঁইসহ সহায়-সম্বল সব হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ৮ জুলাই ঘরে পানি উঠলে পরিবার নিয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হতে হয়েছে। আশ্রয় নিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি নেমে যাওয়ার পর এসে দেখেন ঘরবাড়ি কিছুই নেই। প্রতিমা শীল বলেন, মুহুরী নদীর বাঁধ যেদিন ভাঙে, সেদিন আশপাশের লোকজন না থাকলে আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম না। স্থানীয়রা আমাদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যান। তারা আমাদের সাহায্য করেছেন এবং পরার কাপড় দিয়েছেন। সেই কাপড়ই এখনও পরে আছি। কিন্তু আমাদের ঘর-দুয়ার তো কিছুই নেই। কোথায় থাকব, কে আমাদের আশ্রয় দেবে, কীভাবে কী করব, কিছুই জানি না।
একই অবস্থা পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের উত্তর শালধর গ্রামের মুহুরী নদীপাড়ের বাসিন্দা চাঁপা রানী শীলের। তাঁর দুই মেয়ে তন্বী শীল ও তৃষা শীল। স্বামী শিব কুমার শীল প্রবাসী। চাঁপা শীল জানান, ৮ জুলাই মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে পানি হু-হু করে ঢুকতে থাকে তাদের বাড়িতে। আশপাশের মানুষ তাদের উদ্ধার করে এক কাপড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানে ছয় দিন কাটানোর পর গত সোমবার ফিরে এসে দেখেন, বাড়ির আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন বাড়ির ভাঙা অংশ জোড়াতালি দিয়ে চলছে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা।
শুধু প্রতিমা বা চাঁপা শীল নন, বন্যায় পরশুরাম ও ফুলগাজী এলাকার নদীপাড়ের বাসিন্দাদের শতাধিক ঘর বন্যায় সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে দাগনভূঞা ও সদর উপজেলার প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। তবে অনেক এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ নেই। ইতোমধ্যে ৯ হাজার ৭৬ জন আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে নতুন করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করেছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঞা ও সদর উপজেলার ১৩৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়েন অন্তত দেড় লাখ মানুষ। গতকাল পর্যন্ত ১২১টি গ্রাম থেকে পানি নেমে গেছে। ফলে ভেসে উঠতে শুরু করেছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
বন্যায় জেলায় হাজারের বেশি ঘরবাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতি হয়েছে ফসল, সড়ক, সেতু ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।
ফেনীর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল ফারুক বলেন, এবারের বন্যায় ৩০১ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়কের ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯৫ কোটি।
জেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, এবারের বন্যায় ফেনীর ছয়টি উপজেলার মৎস্য খাতে ১০ কোটি টাকার দুই হাজার ৩০০টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। কৃষিতে পাঁচ হাজার ৮০০ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৮ কোটি। প্রাণিসম্পদ খাদে ৫৭টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত। অন্তত ১০ হাজার হাঁস-মুরগি, চারটি গরু মারা গেছে। এই খাতে ৬৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুরোপুরি পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত পরিমাণ তুলে ধরা হবে।
ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেন বলেন, এবারের বন্যায় বিভিন্ন খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় শতাধিক ঘর আংশিক বা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত পরিমাণ জানানো যাবে।
এদিকে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেছেন, এবার মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪১টি স্থান ভেঙেছে। এরই মধ্যে ভেঙে যাওয়া ছোট বাঁধগুলো মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। তবে ভেঙে যাওয়া বড় বাঁধ মেরামতের জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। বিষয়টি তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জনিয়েছেন।