ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ লাগামহীন হারে বেড়ে যাওয়ায় সম্পদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি সম্পদের পরিমাণ কমছে। এতে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকির মাত্রা। খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামোতে সবচেয়ে বড় আঘাত করছে। যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি বাড়ছে তাদের তত বেশি প্রভিশন ঘাটতি হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ। প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ দুজন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে ২৪টি ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী মূলধন রাখতে পারবে না। ফলে ঋণখেলাপিদের পেটে চলে যাচ্ছে ব্যাংকের মূলধন। সম্প্রতি প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শীর্ষ দুজন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে ব্যাংক খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক খাতে ঋণের পোর্টফোলিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, মূলধন পর্যাপ্ততার ক্ষেত্রে এই খাতটি মারাত্মক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবে। বিভিন্ন ঋণ ঝুঁকি সম্পর্কিত ধাক্কার মধ্যে প্রতিটি ব্যাংকের ২ জন করে শীর্ষ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে তাদের মূলধন কাঠামো ভেঙে পড়বে। এর ধাক্কা প্রথমে আসবে স্বল্প মূলধন রয়েছে এমন ১৯টি ব্যাংকের ওপর। এরপর মাঝারি মানের মূলধন আছে এমন আরও ৫টি ব্যাংক ব্যাংকের প্রয়োজনের তুলনায় মূলধন রাখতে পারবে না। সব মিলে ২৪টি ব্যাংক নতুন করে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে। ফলে ব্যাংক খাতে মূলধন ঘাটতি আরও বাড়বে। তখন ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতায় আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে ঋণের বিপরীতে রাখা জামানত ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আরও ৩ শতাংশ বাড়তে পারে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ ব্যাংকের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি না মানা ও দুর্বল তদারকির কারণে ব্যাংক খাতে ঋণ আদায় কম হচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি হওয়ার পর ওইসব ঋণ আদায় হচ্ছে না। এতে মন্দ ঋণের পরিমাণও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে পৌনে লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। মোট খেলাপির মধ্যে ৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা মন্দ (আদায় অযোগ্য) ঋণে পরিণত হয়েছে। ফলে যত খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তত বেশি ব্যাংকের সম্পদের মান কমছে। পাশাপাশি ব্যাংকের আয় কমায় খেলাপি ঋণের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তখন ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন রাখতে হয়। তখন ব্যাংক আর চাহিদা অনুযায়ী মূলধন রাখতে পারে না। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের নিরাপদ আবরণ তৈরি করতে গিয়ে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে মূলধন। একপর্যায়ে মূলধন ঘাটতিতে পরিণত হচ্ছে ব্যাংক।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ১০ শতাংশের কম মূলধন ছিল ১০টি ব্যাংকের। এক বছরের ব্যবধানে ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণ বাড়ায় ১০ শতাংশ কম মূলধন রয়েছে এমন ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯টি। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে আরও ৯টি ব্যাংকের মূলধন ১০ শতাংশের নিচে চলে গেছে।
১০ শতাংশের বেশি থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ মূলধন রয়েছে গত দুই বছর ধরেই ৪টির রয়েছে। সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি থেকে ১৫ শতাংশ মূলধন ছিল- এমন ব্যাংকের সংখ্যা ২০২৩ সালে ১৫টি। ২০২৪ সালে তা ৫টি কমে ১০টিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ বাড়ায় ৫টি ব্যাংকের মূলধন সাড়ে ১২ শতাংশের নিচে নেমে গেল। ২০২৩ সালে ১৫ শতাংশের বেশি থেকে ২০ শতাংশ মূলধন ছিল- এমন ব্যাংকের সংখ্যা ১৮টি। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪টিতে। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ৪টি ব্যাংকের মূলধন ১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেল। ২০ শতাংশের ওপরে মূলধন গত দুই বছর ধরেই ১৪টি অপরিবর্তিত রয়েছে। বিদেশি ও বেসরকারি খাতের কয়েকটি ভালো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যেমন বাড়ছে না, তেমনি কমছে না মূলধনও।