প্রায় বাইশ বছর ধরে আয়কর দেয় না হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর অব্যাহতিকে প্রতিষ্ঠান দুটির আয়কর অব্যাহতি হিসেবে দাবি করে রিটার্ন জমা দিলেও আয়কর দিচ্ছে না। যদিও আয়কর আইনে আলাদা করে প্রতিষ্ঠান দুটির কর অব্যাহতির সুযোগ নেই। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আয়ের অর্থ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তহবিলে জমাও হয় না। তাই প্রতিষ্ঠান দুটির আয়কর আদায় করতে উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চল। আর বিষয়টি আরও স্পষ্ট করতে এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ব্যাখ্যাও চেয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ২০০২ সালের ৯ অক্টোবর জারি করা একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অলাভজনক সংস্থা হিসেবে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আয়ে কর অব্যাহতি সুবিধা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই প্রজ্ঞাপনের আলোকে কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। কিন্তু সংস্থাটির অধীনে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া রেড ক্রিসেন্ট হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করছে। এ ছাড়া হলি ফ্যামিলি হাসপাতালও একই পথ অনুসরণ করছে। প্রতিষ্ঠান দুটি প্রতি বছর রিটার্ন জমা দিলেও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতিষ্ঠান হিসেবে আয়কর দিচ্ছে না। যদিও আয়কর আইনে প্রজ্ঞাপন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানকে কর অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ বর্তমান আয়কর আইনে নেই। আর প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেড ক্রিসেন্ট হলি ফ্যামিলি কলেজ এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের আলাদা কোনো কর অব্যাহতির প্রজ্ঞাপন নেই। এ ছাড়া ১৯৭৩ সালের ৯ মার্চ জারি করা বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি অর্ডার হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। ওই আদেশেও প্রতিষ্ঠানটির অধীনে থাকা হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল এবং কলেজের কার্যক্রমের বিষয়টি উল্লেখ নেই। এ ছাড়া রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না থাকায় ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশেও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি করযোগ্য হবে না বলেও মতামত দেওয়া হয়। তবে সংস্থাটির কলেজ ও হাসপাতালের বিষয়টি এনবিআরের ওই মতামতেও উল্লেখ নেই। এ ছাড়া ১৯৭৩ সালের এই আদেশে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং হলি ফ্যামিলি কলেজ ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালকে একই স্বত্বা হিসেবে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি, যার কারণে হলি ফ্যামিলি কলেজ এবং হাসপাতাল করযোগ্য বলেও নিশ্চিত করেছেন আয়কর কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হলি ফ্যামিলি কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. মজিবুল হক বলেন, নতুন আয়কর আইনে কর অব্যাহতির বিষয়ে বলা হয়েছে, এই আইন ছাড়া অন্য কোনো আইন বা আইন হিসেবে পরিগণিত অন্য কোনো আইনগত দলিলের বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অন্য আইন বা আইনগত দলিলে যাহা কিছু থাকুক না কেন উপধারা (১)-এর অধীনে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন দ্বারা উক্ত ব্যক্তিকে কর অব্যাহতি না দিলে এই বিধান কার্যকর হবে না বলেও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত চারটি প্রতিষ্ঠানকে কর অব্যাহতি দেওয়া আছে, তার মধ্যে রেড ক্রিসেন্ট হলি ফ্যামিলি কলেজ এবং রেড ক্রিসেন্ট হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল নেই; কিন্তু বাইশ বছর ধরে প্রতিষ্ঠান দুটি আয়কর দিচ্ছে না। এই কারণে প্রতিষ্ঠান দুটির কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চল। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠান দুটিকে আয়কর জমার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির দলিলাদি চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আয়কর না দেওয়ার পক্ষে প্রমাণ চেয়েছেন আয়কর কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন আয়কর কর্মকর্তা বলেন, আয়কর আইনে কর অব্যাহতির বিষয়টি খুবই স্পষ্ট করা আছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কর অব্যাহতি পেতে হলে অবশ্যই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কর অব্যাহতি দিতে হবে। যেহেতু প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি, তাই প্রতিষ্ঠান দুটোকে আয়কর দিতে হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
সূত্র আরও জানায়, বিভিন্ন সময়ে জমা দেওয়া আয়কর রিটার্নে ব্যবসার পরিমাণ উল্লেখ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি আয়করযোগ্য হবে না বলেও দাবি করে আসছে। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের উদাহরণ হিসেবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে ব্যবসা থেকে আয় দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৫৭ লাখ ৩৩৬ টাকা; কিন্তু এই আয়কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত দাবি করে কর দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অডিট রিপোর্টে এফডিআর এবং হাসপাতাল থেকে কলেজে লোন নেওয়াসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বিষয়টি প্রকাশ্যে উল্লেখ করা হলেও কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করে আয়কর দিচ্ছে না। কিন্তু হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অডিটরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্টুডেন্টদের থেকে কালেকশন, পরীক্ষার ফি, ব্যাংক ইন্টারেস্টসহ ৫টি খাত থেকে মোট আয় করেছে ৩৩ কোটি ১৩ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯২ টাকা, যা পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরে ৫ কোটি ৪৭ লাখ ৩৩ হাজার ৫৬৯ টাকা বেড়ে প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে ৩৮ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার ১৬১ টাকা। আর বছর শেষে এই আয়ের পুরো টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে নামমাত্র কিছু টাকা ডোনেশন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও রিটার্নের এবং অডিটের বিষয়টি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখতে চান আয়কর কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ ডা. কে এম মজিবুল হক বলেন, আমরা রেড ক্রিসেন্টের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকি, যে কারণে আমাদের কর দিতে হয় না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমরা যারা কাজ করি, তারা তো আয়কর পরিশোধ করি। এ ছাড়া হলি ফ্যামিলি কলেজের একমাত্র আয় আসে টিউশন ফি থেকে। এতে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। এসব কারণে মূলত আয়কর হয় না।
প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপন ছাড়া কর অব্যাহতির কোনো সুযোগ নেই বর্তমান আয়কর আইনে—এ বিষয়ে তিনি জানেন না বলে দাবি করেন।