পাঠ্যবই ছাপার আগেই ৭শ টন কাগজ বাতিল

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৫ | ৮:৪৮ পূর্বাহ্ণ
মোঃ রাছেল রানা, প্রধান সম্পাদক

২০২৬ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে মান নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকেই এবার ‘শূন্য সহনশীল’ সরকার। নিম্নমানের বই ছাপানোর সব কৌশল ধরতে নেওয়া হয়েছে ‘কচ্ছপের কামড়’ বা নাছোড়বান্দা নীতি। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১২টি শর্তে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এর একটি শর্তও প্রতিপালন না করলে সংশ্লিষ্ট মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের দরপত্র বাতিল করা হবে। এসব শর্তের ফলও মিলতে শুরু করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) দৃশ্যমান পদক্ষেপে ছাপার কাজ শুরুর আগেই প্রায় ৭০০ টন কাগজ বাতিল করেছে পরিদর্শন এজেন্সি। এরই মধ্যে ছাপাখানায় আসার পর বাতিল হয়েছে ১০০ টন কাগজ। শিশুদের চোখের সুরক্ষায় অপটিক্যাল ব্রাইটনিং এজেন্ট (ওবিএ)-মুক্ত কাগজ, বর্ধিত স্থায়িত্ব, পুরুত্বসহ নতুন মানদণ্ড নিশ্চিত করতে মাঠে কাজ করছেন মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমের বই নিয়ে বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিক বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে সরকার। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারের দায়িত্ব গ্রহণের পর এটিই প্রথম বই ছাপার বড় কাজ। এটিকে সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য তিনি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নির্দেশনার পরই নড়েচড়ে বসেছে এনসিটিবি। এরই মধ্যে কয়েক দফা ট্রায়ালের পর গত শনিবার থেকে প্রাথমিক স্তরে ৯ কোটি বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। ৬১টি প্রেস এই স্তরের কাজ করছে। নিম্নমানের বই ছাপানো ঠেকাতে পরিদর্শন এজেন্সির একজন প্রতিনিধি প্রতিটি প্রেসে সার্বক্ষণিক নিয়োগ করা হয়েছে। এজেন্সির লোক প্রথমে প্রেসে কাগজের মান (স্থায়িত্ব ও জিএসএম), ওবিএ-মুক্ত আছে কি না, তা দেখে ছাড়পত্র দেবেন। এই স্তরকে প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন বা পিডিআই বলে। এই স্তর শুরুর আগেই বিভিন্ন ছাপাখানার ৬০০ টন কাগজ তাদের নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে দরপত্র অনুযায়ী শর্ত পূরণ না হওয়ায় সেসব কাগজ কেনার অনুমতি মেলেনি। অন্যদিকে, প্রাথমিক ছাড়পত্র পাওয়ার পরও কাগজে সমস্যা থাকায় দুটি ছাপাখানার প্রায় ১০০ টন কাগজ বাতিল করেছে এজেন্সি। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিশুদের চোখের সুরক্ষার কথা ভেবে চিকিৎসকদের পরামর্শে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছে ওবিএ-মুক্ত কাগজের শর্ত। এ ধরনের অফ-হোয়াইট বা প্রাকৃতিক রঙের কাগজ উৎপাদনে শতভাগ ‘ভার্জিন পাল্প’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এর পাশাপাশি কাগজের স্থায়িত্ব (বাস্টিং ফ্যাক্টর) ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ এবং কাগজের পুরুত্ব (জিএসএম) ৮২ থেকে ৮৫ গ্রাম করা হয়েছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো ‘অপাসিটি’। অর্থাৎ, কাগজের এক পৃষ্ঠার লেখা যেন অন্য পৃষ্ঠা থেকে দেখা না যায়। এসব শর্ত এমনভাবে একটির সঙ্গে অন্যটি যুক্ত যে, একটি মানা না হলে অন্যটিও পূরণ হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাধারণ ২০ বাস্টিং ফ্যাক্টরের কাগজ শতভাগ মন্ড দিয়ে উৎপাদন করতে হয়। কোনো কাগজে ‘ভার্জিন’ (অব্যবহৃত) মন্ডের সঙ্গে ‘রিসাইকেল্ড’ (ব্যবহৃত) মন্ড মিলিয়ে কাগজ বানালে বাস্টিং ফ্যাক্টর ২০ আসবে না। এলেও ‘ওবিএ’ আসবে না। অর্থাৎ, সঠিক বাস্টিং ফ্যাক্টর হলেই ওবিএ-মুক্তি কাগজ হবে। ওবিএ হলো—কাগজে এক ধরনের প্রাকৃতিক রং বা অফ-হোয়াইট কালার। এই কালার হলে শিশুদের চোখের সমস্যা হবে না। পাশাপাশি লেখাগুলো স্বচ্ছ হবে। চিকিৎসকদের পরামর্শে শিশু শিক্ষার্থীদের চোখের সুরক্ষায় চলতি বছর প্রথম এমন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন একটি শর্ত ছিল ‘অপাসিটি’। এটি হলো—কাগজের এক পৃষ্ঠার লেখা যাতে অন্য পাশে দেখা না যায়। সেজন্য কাগজে পর্যাপ্ত অপাসিটি থাকতে হয়। বই ছাপায় কাগজের সাধারণত অপাসিটি বেশি থাকে। চলতি বছর ৭০ জিএসএম কাগজের জন্য ৮৫ এবং ৮০ জিএসএমের জন্য ৯০ শতাংশ অপাসিটি নির্ধারণ করা হয়। সাধারণ নিয়ম হলো কাগজের জিএসএম যত বেশি হবে, তত কম লেখা অন্যপাশে ফুটে উঠবে। তবে সবসময় জিএসএম বেশি হলেই যথেষ্ট নয়। কারণ অপাসিটি ও ফিলার মেটেরিয়াল (পাল্পর সঙ্গে মেশানো খনিজ পদার্থ বা রাসায়নিক উপাদান, যা কাগজের অপাসিটি, মসৃণতা, উজ্জ্বলতা ও প্রিন্টিং কোয়ালিটি বাড়ায়) সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্টরা জানান, পুরোনা কাগজ ‘রিসাইকেল্ড’ বা পুনর্ব্যবহার এবং আংশিক পাল্প মিলিয়ে কাগজ বানালে ২০ শতাংশ বাস্টিং ফ্যাক্টর আসবে না। এসব শর্ত এমনভাবে একটির সঙ্গে অন্যটি যুক্ত; একটি মানা না হলে অন্যটিও পূরণ হবে না। ফলে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহারের সুযোগ এবার সেই সুযোগ নেই। প্রেস মালিকরা জানান, কাগজে নতুন ও কঠোর শর্তের কারণে প্রেস মালিক এবং পেপার মিলগুলো শুরুতে কিছুটা দ্বিধায় ছিল। বিশেষ করে কাগজের অপাসিটি নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়। এনসিটিবি ৮০ জিএসএম কাগজে ৯০ শতাংশ এবং ৭০ জিএসএমে ৮৫ শতাংশ অপাসিটি নির্ধারণ করে। কিন্তু পেপার মিলগুলো জানায়, তাদের পক্ষে সর্বোচ্চ ৮৫ ও ৮০ শতাংশ অপাসিটি দেওয়া সম্ভব। এ বিতর্কের কারণে প্রায় এক সপ্তাহ কাজ আটকে ছিল। প্রেস মালিকরা আগেই পেপার মিল থেকে কাগজের নমুনা নিয়ে বিএসটিআই, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) দিয়ে অগ্রিম পরীক্ষা করায়। সেখানে পাস হওয়ার পর সেসব কাগজের নমুনা পরিদর্শন এজেন্সির ল্যাবে পাস হয়নি। এজেন্সির ল্যাবে বাস্টিং, ওবিএ সঠিক পেলেও অপাসিটি সঠিক আসেনি। ফলে কাজ শুরুর আগেই ৬০০ টনের বেশি কাগজ বাতিল করা হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার এনসিটিবি, পেপার মিল, প্রেস মালিকদের নিয়ে ত্রিপক্ষীয় একটি বৈঠক হয়। সেখানে মিলগুলো অপাসিটির পরিমাণ নিয়ে আপত্তি তুলে বলেন, এনসিটিবি না বুঝেই সেটি ৯০ এবং ৮৫ শতাংশ করে দরপত্র দিয়েছে। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে অপাসিটি ৯০ থেকে কমিয়ে ৮৫ এবং ৮৫ থেকে কমিয়ে ৮২ শতাংশ করে বই ছাপার অনুমতি দেয় এনসিটিবি। এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, চলতি বছর বইয়ের মানের বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। যত ধরনের মেকানিজম আছে, সব প্রয়োগ করা হচ্ছে। যারা বইয়ের ছাপার কাজ তদারকি করবেন, তাদেরও নানা কৌশলে তদারকির জন্য আলাদা টিম থাকবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের এক্সপোর্ট অ্যান্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সব পেপার মিল যাতে একই মানের কাগজ উৎপাদন করতে পারে, সেজন্য আমরা অপাসিটি ৮৫ ও ৮২ চেয়েছি। তবে কাগজের টেকনিক্যাল কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন অপাসিটি ৫ শতাংশ কমালেও কাগজের মানে উল্লেখযোগ্য কোনো হেরফের হবে না।’ বই মুদ্রণ শাখার কর্মকর্তারা জানান, এত কিছুর পরও নিম্নমানের বই ছাপা বন্ধ করতে নানা ফাঁকফোকর বের করছেন প্রেস মালিকরা। সেটি ঠেকাতে চলতি বছর এনসিটিবি প্রথমবারের মতো প্রতিটি ফর্মায় বাধ্যতামূলকভাবে সংশ্লিষ্ট প্রেসে নাম ছাপানোর নিয়ম করেছে। ফলে বই বিতরণের পর কোনো সমস্যা বা মানহীনতা ধরা পড়লে দায়ী প্রতিষ্ঠান সহজে শনাক্ত করা যাবে। একই সঙ্গে দ্বৈত ল্যাবে কাগজ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি প্রেসে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হবে, যা এনসিটিবি থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে। ২৪ ঘণ্টা মুদ্রণ প্রক্রিয়া সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি পরিদর্শন এজেন্সির ওপর কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কাগজের মান পরীক্ষা করতে একটি ল্যাব সরাসরি এনসিটিবিতে স্থাপন করা হবে। যাতে কোনো প্রেস মালিক পরিদর্শন এজেন্সিকে প্রভাবিত করতে না পারেন। সর্বশেষ ইআরসি (এক্সপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট) সংক্রান্ত নিয়মেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে বিল জমার সময় এই সার্টিফিকেট নেওয়ার বিধান থাকলেও এবার বই ডেলিভারির আগেই তা নিতে হবে। এতে মানহীন প্রতিষ্ঠানগুলো বই ছাপার সুযোগ পাবে না। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিকের ৯ কোটি ১৯ লাখ এবং মাধ্যমিকে ২১ কোটি ৪২ লাখ বইয়ের জন্য ৮২৬টি লটে ভাগ করে বই ছাপার দরপত্র দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের বইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু নানা অনিয়ম ও সাবেক একজন মন্ত্রীর ভাইকে কাজ দেওয়ায় গত ১৯ আগস্ট ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য ১১ কোটি ৮৯ লাখ ৩২ হাজার ৮০২ কপি বই ছাপানোর প্রস্তাব আটকে দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ (ক্রয় কমিটি)। নবম শ্রেণি বইয়ে দরপত্র মূল্যায়ন পর্যায়ে রয়েছে। চলতি সপ্তাহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কথা রয়েছে।