প্রযুক্তির যুগে জ্ঞানার্জনের উৎসের অভাব নেই। ঘরে বসেই দ্বীন-দুনিয়ার সব কিছু এখন জানা সম্ভব। মাতৃভাষায় কোরআন-হাদিস, ইসলামী বই অধ্যয়ন করা যায়। ইউটিউবে আলেমদের বক্তব্য শোনা যায়। জুমার খুতবায় ইসলাম সম্পর্কে জানা যায়। পত্র-পত্রিকা থেকেও দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা যায়। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্বীনি জ্ঞান চর্চার ব্যাপক আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু অর্জিত জ্ঞানের প্রতিফলন নেই আমাদের দৈনন্দিন আচরণে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, দাওয়াতের ময়দানে, রাজনীতিতে কিংবা পারিবারিক জীবনে। ফলে জ্ঞানের প্রদীপ হাতে থাকলেও আমলের শক্তি না থাকার কারণে আমরা যেন অন্ধকার জগতের এক দিশেহারা পথিক। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ফুটে উঠেছে ঈমানি দুর্বলতার সুস্পষ্ট প্রভাব। যে ইলম আমল উৎপন্ন করে না, তা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
পবিত্র কোরআনে বনি ইসরাইলের সেই আলেমদের উদাহরণ এসেছে, যারা তাওরাত জানত; কিন্তু তাওরাতের বিধান অনুযায়ী আমল করত না। তাদের গাধার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যে না বুঝেই শুধু বইয়ের বোঝা বহন করে।
আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাওরাত বহনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল, অতঃপর তারা তা বহন (তা অনুসারে আমল) করেনি, তাদের দৃষ্টান্ত হলো গাধার মতো, যে কিতাবের বোঝা বহন করে। কতই না মন্দ সেই সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে।’ (সুরা জুমুআ, আয়াত : ৫)
মুসলিম সমাজে এমন শিক্ষিত ব্যক্তির অভাব নেই, যারা জ্ঞানের দিক থেকে অনেক এগিয়ে, কিন্তু তাদের অনেকেই ইসলামী নীতি-আদর্শকে জীবনে প্রয়োগ করেন না।
আসলে দুনিয়া হলো আমল করার জায়গা। আর আখিরাত হলো আমলের ফল ভোগ করার জায়গা। তাই ইলম অর্জনের পর তা বাস্তবে প্রয়োগ করাই মূল উদ্দেশ্য।
আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বলো, তোমরা কাজ করে যাও। অচিরেই তোমাদের কাজ দেখবেন আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও ঈমানদাররা। শিগগির তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে সেই সত্তার কাছে, যিনি গোপন ও প্রকাশ্য বিষয়ে অবগত। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০৫)
আল্লাহর কাছে আমলের পরিমাণের চেয়ে মান ও কোয়ালিটি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সামান্য সৎকর্মও ইখলাস ও আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পন্ন হলে আল্লাহ তা কবুল করেন এবং এর মাধ্যমে বান্দাকে জান্নাত দান করেন।
নবী কারিম (সা.) বলেন, হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমল করতে থাক। কারণ আল্লাহ (সওয়াব দানে) ক্লান্তিবোধ করেন না, যতক্ষণ না তোমরা (আমল সম্পাদনে) ক্লান্ত হয়ে পড়। আর আল্লাহর কাছে ওই আমল সবচেয়ে প্রিয়, যা অল্প হলেও নিয়মিত করা হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৮৬১)
ইলম ও আমল হলো রেল লাইনের দুটি পাতের মতো, যার একটি ছাড়া অন্যটি অচল। আমলবিহীন ইলমের কোনো মূল্য নেই, তেমনি ইলমবিহীন আমলেরও মূল্য নেই।
ইলম ও আমলের সমন্বয়ে ফুটে ওঠে মুমিন বান্দার প্রকৃত দ্বীনদারি। আমাদের দরকার ইলম ও আমলের সমন্বয়।
আলী ইবনু আবী তালিব (রা.) বলেন, ‘হে জ্ঞানধারীরা! তোমরা তোমাদের জ্ঞান অনুযায়ী আমল করো। কারণ প্রকৃত আলেম তো সেই ব্যক্তি, যে জ্ঞান অর্জন করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে এবং যার আমল তার জ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আগামীতে এমন কিছু লোক আসবে, যারা জ্ঞান বহন করবে, কিন্তু সেই জ্ঞান তাদের গলার নিচে নামবে না (অন্তরে প্রবেশ করবে না, প্রভাব ফেলবে না)। তাদের অন্তরের অবস্থা ও বাহ্যিক প্রকাশ পরস্পরবিরোধী হবে। তাদের আমলও তাদের জ্ঞানের বিরোধিতা করবে। তারা বৈঠকে বসবে এবং একে অপরের সামনে নিজেদের জ্ঞান নিয়ে গর্ব করবে। এমনকি একজন ব্যক্তি তার সাথীর ওপর রাগান্বিত হবে শুধু এই কারণে যে সে গিয়ে অন্য কারো পাশে বসেছে এবং তাকে (আগের জনকে) ছেড়ে দিয়েছে।
এমন লোকদের কোনো আমলই তাদের ঐসব বৈঠক থেকে আল্লাহর কাছে উঠবে না (কবুল হবে না)।’ (ইবনু আবদিল বার, জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদ্বলিহি : ১/৬৯৭)