একসময় যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানকে \'মিথ্যা ও প্রতারণা\' ছাড়া কিছু দেয়নি বলে প্রকাশ্যেই কঠোর সমালোচনা করে সামরিক সহায়তা বন্ধ করেছিলেন, সেই তিনিই এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে ওভাল অফিসে বসিয়ে \'খুব দারুণ মানুষ\' বলে প্রশংসা করছেন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি ছিল ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদ সম্পর্কের এক অবিশ্বাস্য দ্রুত পরিবর্তন এবং কয়েক দশকের মধ্যে পাকিস্তানের কোনো সেনাপ্রধানের জন্য হোয়াইট হাউসে দ্বিতীয়বারের মতো বৈঠক করার বিরল সুযোগ।
যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের এই নাটকীয় মোড় পরিবর্তন কোনো আদর্শিক বা কৌশলগত মহাপরিকল্পনার ফল নয়; বরং এটি সরাসরি ট্রাম্পের \'আমেরিকা ফার্স্ট\' নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু লেনদেনভিত্তিক পদক্ষেপের ওপর নির্মিত।
পাকিস্তানের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে গৃহীত কিছু কার্যকর পদক্ষেপ ট্রাম্প প্রশাসনকে সন্তুষ্ট করতে সাহায্য করেছে:
১. অ্যাবি গেট বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারীর গ্রেপ্তার: ২০২১ সালে কাবুলে অ্যাবি গেট বোমা হামলায় ১৩ মার্কিন সেনা নিহতের মূল অভিযুক্ত মোহাম্মদ শরিফুল্লাহকে গত মার্চে সিআইএর তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি বাহিনী আটক করে। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে বিশৃঙ্খল প্রত্যাহারের পর ট্রাম্পের কাছে এটি ছিল মার্কিন জনগণের সামনে একটি স্পষ্ট ও ব্যক্তিগত বিজয়।
২. নোবেল শান্তি পুরস্কারের তোষামোদ: মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ বন্ধের পর ইসলামাবাদ অতি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপকে শান্তি স্থাপনের কারণ হিসেবে স্বীকার করে। নয়াদিল্লি এই দাবি প্রত্যাখ্যান করলেও পাকিস্তান এক ধাপ এগিয়ে ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে। পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করা ট্রাম্পের অহংবোধকে খুশি করার এটি ছিল একটি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ কৌশল।
৩. অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের ইঙ্গিত: সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের বিরল খনিজ ও তেল অনুসন্ধানসহ ট্রাম্পের পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রকল্পের জন্য চুক্তি করা হচ্ছে। ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী পাকিস্তানে \'বিশাল তেলের মজুত\' থাকাটা জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও, এটি নতুন ভূ-অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের ইঙ্গিত দেয়। পাকিস্তানের সম্পদের ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকারের বিনিময়েই ইসলামাবাদকে ভারতের তুলনায় অনেক কম শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাইডেন প্রশাসনের সময় উপেক্ষার পাত্র হওয়া সত্ত্বেও, বর্তমান প্রশাসন সরাসরি পাকিস্তানের সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। ওয়াশিংটনের জন্য এটি সুবিধাজনক কারণ এটি দেশটির প্রকৃত ক্ষমতার কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের বারবার যুক্তরাষ্ট্র সফর (ওভাল অফিসসহ) এই বাস্তবতারই স্বীকৃতি।
পাকিস্তানের জন্য এই আমেরিকান আলিঙ্গন বড় ধরনের কূটনৈতিক সুরক্ষা এনে দিয়েছে এবং ইসলামাবাদকে চীন ও সৌদি আরবের মতো দেশের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী ভূ-অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করার স্বাধীনতা দিয়েছে, যা পূর্ববর্তী মার্কিন প্রশাসন গভীর সন্দেহের চোখে দেখত। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, এই উষ্ণ সম্পর্ক যৌথ আদর্শের ভিত্তিতে নয়, বরং পারস্পরিক স্বার্থের কারণে তৈরি হয়েছে এবং মার্কিন-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে এমন উত্থান-পতন নতুন কিছু নয়।