১৯ বছর ধরে ইসরায়েলে বন্দি কে এই ‘দ্বিতীয় ইয়াহিয়া সিনওয়ার’?

প্রকাশিতঃ অক্টোবর ১০, ২০২৫ | ৫:৩৪ অপরাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গাজা উপত্যকার ভয়াবহ সংঘাত ও গণহত্যার অবসানে অবশেষে ইসরায়েলের সঙ্গে পরোক্ষ সমঝোতায় পৌঁছেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এ সমঝোতায় পৌঁছানো হয়েছে বলে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) ভোররাতে এক বিবৃতিতে ঘোষণা দিয়েছে হামাস। হামাস জানিয়েছে, এই সমঝোতা চুক্তিতে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, যুদ্ধের সমাপ্তি, জরুরি মানবিক সহায়তা প্রবেশ এবং বন্দি বিনিময়ের বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সংগঠনটি আরও জানায়, এই প্রস্তাবের বিষয়ে বিভিন্ন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সঙ্গে ‘দায়িত্বপূর্ণ ও গভীর আলোচনা’ করে তবেই তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বন্দি বিনিময়ের বিষয়টিও উঠে এসেছে সামনে। আর এই প্রসঙ্গেই আবার আলোচনায় এসেছে ইব্রাহিম হামেদ– হামাসের প্রভাবশালী এক নেতা, যিনি বর্তমানে ইসরায়েলের কারাগারে আছেন। আরব ও ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বন্দি বিনিময়ের আলোচনায় ইব্রাহিম হামেদের মুক্তির দাবি স্পষ্টভাবে তুলেছে হামাস। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা শাবাক (Shin Bet) তাকে ‘দ্বিতীয় ইয়াহিয়া সিনওয়ার’ বলে উল্লেখ করেছে, অর্থাৎ হামাসের গাজা শাখার প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের চেয়েও সমান বা বেশি প্রভাবশালী মনে করে তাকে। ইব্রাহিম হামেদ পশ্চিম তীরে হামাসের সামরিক শাখার সাবেক কমান্ডার এবং তিনি ৫৪টি যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ইয়েদিওথ আহরোনোথ (Yedioth Ahronoth) জানিয়েছে, সম্প্রতি মিশরের শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় হামেদকে মুক্তি দেওয়ার দাবি বিশেষভাবে উত্থাপন করে হামাস। ইব্রাহিম হামেদ দ্বিতীয় ইন্তিফাদা, যা ছিল ২০০০ সালে শুরু হওয়া ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিদের একটি বড় বিদ্রোহ, যা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ও ইসরায়েলে সংঘটিত হয়। এর তীব্র সহিংসতার সময়কাল ২০০৫ সালের শারম আল-শেখ শীর্ষ সম্মেলন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এরপর থেকে এর তীব্রতা কমে আসে। তিনি ওই সময়ে হামাসের শহীদ অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পরিচিত এবং বছরের পর বছর ধরে শাবাক তাকে অনুসরণ করতে থাকে। অবশেষে ২০০৬ সালে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং ২০১২ সালে তাকে ৫৪ বছরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। হিব্রু ভাষার এই সংবাদমাধ্যমটি বলছে, হামাসের সঙ্গে আলোচনার সময় মারওয়ান আল-বারগুথি এবং আহমেদ সাদাতসহ ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের মুক্তির বিরোধিতা করে আসছে ইসরাইল এবং ইব্রাহিম হামেদসহ অন্যান্য বিশিষ্ট বন্দিদের মুক্তিতে সম্মত হয়েছে কিনা- তা এখনো স্পষ্ট নয়। বন্দি বিনিময় চুক্তির আলোচনার কাঠামোর মধ্যে এই অনুরোধ করা হয়েছিল, যা হামাস আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আংশিকভাবে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ১৯৬৫ সালে পশ্চিম তীরের রামাল্লাহর পূর্বে সিলওয়াদ শহরে জন্মগ্রহণকারী ইব্রাহিম হামেদ পশ্চিম তীরে হামাসের অন্যতম বিশিষ্ট সামরিক কমান্ডার। তিনি বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন এবং ১৯৯০ সাল থেকে হামাসের সামরিক কাঠামোতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। ১৯৯৮ সালে দুই জ্যেষ্ঠ হামাস কমান্ডার ইমাদ ও আদেল আওয়াদাল্লাহ শহীদ হওয়ার পর ইব্রাহিম হামেদ পশ্চিম তীরে হামাসের সামরিক শাখার নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। শিন বেত তাকে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় কয়েক ডজন সামরিক ও আত্মঘাতী অভিযানের প্রধান পরিকল্পনাকারী বলে মনে করে; যার মধ্যে রয়েছে গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণ, সামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ এবং শহীদ অভিযান। ইসরায়েলি সূত্র অনুসারে- ওই সময় কয়েক ডজন সৈন্য এবং বসতি স্থাপনকারীদের হত্যা করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর থেকে হামেদকে ইসরায়েলি কারাগারের নির্জন কক্ষে রাখা হয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। তবুও ইসরায়েলি মিডিয়া অনুসারে, জিজ্ঞাসাবাদের কোনো পদ্ধতিই তাকে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করতে পারেনি। শিন বেত তাকে ‘অটুট পাথর’ হিসাবে বর্ণনা করেছে এবং স্বীকার করেছে যে, হামেদের চেয়ে কোনো বন্দির বিরুদ্ধে তারা কখনো এতোটা অসহায় ছিল না। ইব্রাহিম হামেদকে কখনোই তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।উলটো তিনি কারাগারের কঠোর অবস্থার কারণে গুরুতর শারীরিক আঘাত পেয়েছেন, যার মধ্যে একটি হলো- ছিঁড়ে যাওয়া ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট এবং অন্যটি হার্নিয়েটেড ডিস্কও রয়েছে। অন্যদিকে তার স্ত্রীকে মুক্তি দেওয়া হলেও তাকে ও তার সন্তানদেরও জর্ডানে নির্বাসিত করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্দি বিনিময় আলোচনায় হামাস ইব্রাহিম হামেদের নাম বারবার উল্লেখ করলেও ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীকী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি এখনো রয়ে গেছেন। সর্বশেষ গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুসারে, প্রথম পর্যায়ে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ৭২ ঘণ্টা পর হামাস এক সঙ্গে ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দিকে হস্তান্তর করবে এবং ইসরায়েল ২০০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যার মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন এবং ১,৭০০ জন গত দুই বছর ধরে আটক রয়েছেন।