পরপর তিনদিনে দেশের তিন প্রান্তে আগুন। কোথাও কারখানা, কোথাও ব্যাংক-বাজার-বাসাবাড়ি, আবার বিমানবন্দর। আগুন নিভছে না- আগুন নিভে গেলেও ছাই থেকে ধোঁয়া উঠছে রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনীতির সর্বত্রে। একের পর এক অগ্নিকাণ্ড এখন কেবল দুঃসংবাদ নয়, বরং জাতির স্নায়ুতে লেগে থাকা অসাড়তার প্রতীক। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়, এই আগুন কি কেবলই দুর্ঘটনা, নাকি কোনো গভীর ক্ষত বা দূর্বিষহ রোগের লক্ষণ ?
বাংলাদেশে এখন আগুন মানে শুধু ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার পতন, রাজনৈতিক বিবেকের দেউলিয়ানার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়ণ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব, সব মিলিয়ে প্রতিটি দাহ যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতরকার দগদগে ক্ষতকে আরও উন্মোচন করছে।
অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি হয়, প্রেস ব্রিফ হয়, শোক প্রকাশও হয়। কিন্তু দায় কারো নয়। যাদের অনুমোদন ও নজরদারির দায়িত্ব, তারা আবারই ‘অজানা কারণে’ আগুন লাগার পুরনো বুলি আওড়ান। অথচ প্রত্যেক ঘটনায় একই ধাঁচ, একই গল্প, একই মৃত্যু। মনে হয় যেন আগুনও এখন ‘নীতিনির্ধারিত’- কারও জন্য সুবিধাজনক, কারও জন্য প্রয়োজনীয়।
চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা আরো ভয়াবহ। আওয়ামী ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বিএনপি-জামায়াতের সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক আগ্রহ, প্রশাসনের পলিসি প্যারালাইসিস সব মিলিয়ে দেশে এখন এক ধরনের অরাজনৈতিক \'রাজনীতি\' চলছে। যেখানে মানুষ নয়, প্রাধান্য পাচ্ছে প্রভাব।
রাষ্ট্রের চোখে সাধারণ নাগরিক কেবল পরিসংখ্যান; মানুষ নয়, দায়ও নয়, মূল্যহীন জীব।
অর্থনীতি ডুবে যাচ্ছে মুদ্রাস্ফীতিতে, কর্মসংস্থান কমছে, ব্যয় বাড়ছে, বৈদেশিক ঋণের চাপও বাড়ছে। তার মধ্যে এই অগ্নিকাণ্ডগুলো যেন দেশের ভেতরের আর্থসামাজিক দাহকে প্রতীকীভাবে প্রকাশ করছে। যখন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি কাঁপে, তখন সমাজের অবকাঠামোও নিরাপদ থাকে না- কারণ দুর্নীতি তখন সেফটি ট্যাঙ্ক, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, বিল্ডিং পারমিট- সবকিছুই গিলে ফেলে দায়বদ্ধতাকে।
আমরা দেখছি, মানুষ এখন আগুন নিভানোর আগে ছবি তুলছে, ভিডিও করছে, শেয়ার করছে, শোক জানাচ্ছে। কিন্তু এই সমাজে কেউ প্রশ্ন করছে না- আগুন কে লাগায়, আগুনে কারা বাঁচে ? আমরা একবারও ভাবিনা
এই নীরবতা আগুনের চেয়ে আমাদের জন্য আরো ভয়ংকর হতে পারে।
রাষ্ট্র এখন ছাই চাপা আগুনের মতোই ধোঁয়াশায় ঢাকা- কে শাসন করছে, কে দায় নিচ্ছে, কারা সুবিধাভোগী, তার হিসাব মিলছে না। রাজনীতি আর সুশাসন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়েছে। এমন এক সময় এসেছে যখন আগুন শুধু বস্তু পুড়িয়ে দিচ্ছে না, আমাদের বিবেক, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ সবকিছু পুড়িয়ে ছাই-ভষ্ম করে দিচ্ছে । আগুনের এই ধারাবাহিক লেলিহান দাবালনের উচ্ছ্বাস জাতির জন্য শুধু দুর্ভাগ্য নয়, এটা জাতির জন্য অশনি সংকেত।
রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজকে এখনই জেগে উঠতে হবে- নইলে কোনো একদিন হয়তো এই আগুন রাষ্ট্রের অবকাঠামো ফাইল, পিতা-মাতার স্বপ্নে লালিত সন্তানের ভবিষ্যত কিংবা সম্ভাবনার আঁতুড় ঘর থেকে শুরু করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকেও ছাই করে দেবে।
কুষ্টিয়া। তাং ১৯ অক্টোবর ২০২৫