ব্যবসায় মন্দা রাজস্বে ঘাটতি

প্রকাশিতঃ অক্টোবর ২৮, ২০২৫ | ৯:১৮ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সরকার-রাজনৈতিক দল এখন নির্বাচনমুখী। অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাওয়ার আলোচনা। আছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, জুলাই-আগস্টে গণহত্যার বিচার ইত্যাদি ইস্যু। এত সব ইস্যুর চাপে মোটাদাগে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বিনিয়োগ সংকটের বিষয়টি এখন প্রায় আড়ালে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স আর রপ্তানিতে সাময়িক স্বস্তি ছাড়া সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানের বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত মনোযোগ হারিয়েছে। ফলে মন্দা ব্যবসার চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে সরকারের রাজস্ব আয়। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ থেকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থবছরের তিন মাসে উচ্চ প্রবৃদ্ধির মধ্যে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ রাজস্ব ঘাটতি পড়েছে। সংস্থাটি মরিয়া হয়ে এখন অসম্ভব হলেও মামলায় আটকে থাকা রাজস্ব, বকেয়া ভ্যাট-ট্যাক্স আর কর ফাঁকি থেকে রাজস্ব আদায়ে বিশেষ তৎপরতা চালিয়ে চালিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করছে। ব্যবসায়ী-অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা ও ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতি আর রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত অর্থনীতিতে গতি ফিরবে না। সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ। আগের সরকারের ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদের হারসহ নানা সমস্যা অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করে রাখে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদরা দায়িত্ব পাওয়ায় আশা করা হয়েছিল, এ পরিস্থিতি থাকবে না, বরং অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াবে। এই সরকারের প্রায় ১৪ মাসে রেমিট্যান্স, রিজার্ভ ও রপ্তানিতে কিছুটা ইতিবাচক ধারা ছাড়া তেমন সাফল্য নেই। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. সাদিক আহমেদ বলেন ‘সরকারি-বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই খরচ কমে গেছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের হারও অনেক কম। কারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা, জ্বালানি খাত, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও অন্যান্য বিষয় দেখেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আসবেন। এই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নির্বাচিত সরকার হয়তো এ বিষয়কে গুরুত্ব দেবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হবে কি না, বিনিয়োগের নিশ্চয়তা থাকবে কি না—এসব দেখেই সামনে এগোবে সবাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখনো বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও গ্যাসের সরবরাহে সমস্যা আছে। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ ভিয়েতনাম-ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। এগুলোর ওপর জোর দিতে হবে। অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম চালু হয়েছে। এটায় হয়তো আরো এক-দুই বছর লাগবে, তারপর পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। তখন স্বাভাবিকভাবে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।’ সর্বশেষ হিসাবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেলেও এটিও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বেসরকারি খাত স্থবির, কোনো বিনিয়োগ নেই। শিল্পের উৎপাদন সংকুচিত। একে একে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। উচ্চ সুদে কেউ ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চাচ্ছে না, আবার নতুন কারখানায়ও বিনিয়োগ করছে না। অর্থাৎ কেনাকাটাই হচ্ছে না ঠিকমতো। সাধারণেরও সীমিত আয়ের বিপরীতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যের চাহিদা ও ভোগ ব্যয় কমে গেছে। যার ফলে কমছে আমদানি। বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি কমছেই। আমদানির ব্যয় সংকোচন করায় জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে আমদানি কমেছে ১৬.৭১ শতাংশ। এতে ডলার খরচ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২.১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, রিজার্ভ বাড়ছে—এটা ভালো খবর। তবে অর্থনীতির ভাষায় এটি যত না ‘ভালো খবর’ তার চেয়ে ‘আশঙ্কার’ বিষয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, খেয়ে না খেয়ে মরিয়া হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াচ্ছে ঠিক আছে; কিন্তু অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় আমদানি না হলে সার্বিক অর্থনীতির সাপ্লাই চেইনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর অর্থ হলো—শিল্পের চাহিদা কমে গেছে। বিনিয়োগ থমকে আছে। এর প্রভাবে অর্থনীতির গতি স্লথ হয়। মানুষ কাজ হারায়। ব্যবসার আয় কমে যায়। প্রবৃদ্ধি কমে যায়। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায়ও হয় না। অর্থাৎ ব্যবসার মন্থরগতির জন্য সরকারের অভ্যন্তরীণ আয় একটি চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্যবসায় মন্দা থাকায় জোর করে রাজস্ব আদায় করা কঠিন। তাই সংস্থাটি মামলায় আটকে থাকা বিপুল অঙ্কের রাজস্ব, বকেয়া রাজস্ব আর কর ফাঁকির বড় অঙ্কের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে। এটি বেশ কঠিন কাজ। এর পরও মরিয়া হয়ে এনবিআরের ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর বিভাগ নিজ নিজ ক্যাপাসিটিতে এসব উৎস থেকে বাড়তি রাজস্ব আদায় করে ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিলে রাজস্ব আদায়ে তার একটা প্রভাব পড়ে। ব্যবসায় মন্দা থাকায় কোথাও কর আদায়ের জন্য জোরালো পদক্ষেপও নেওয়া যাচ্ছে না। একটা প্রতিষ্ঠান যদি বেঁচে থাকে তাহলে রাজস্ব আদায় হবে। আর এখন চাপাচাপি করে যদি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়, তাহলে রাজস্ব আদায়ের একটি দরজাই বন্ধ হয়ে যাবে।’ এখন রাজস্ব আদায়ে কী কৌশল অবলম্বন করছে এনবিআর? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বকেয়া কর আদায়ে মনযোগ দেওয়া, কর ফাঁকি বন্ধ করা, যেসব বিতর্কিত-অবিতর্কিত করের টাকা আদালতের মাধ্যমে আটকে আছে তা পুনরুদ্ধার, করদাতাবান্ধব বিভিন্ন সেবা দেওয়া, কোনো ধরনের হয়রানি প্রতিরোধ, এক জায়গায় সব ধরনের সেবা প্রদানের উদ্যোগ, সব খাতে অটোমেশনসহ নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।’ তথ্য-উপাত্ত বলছে, মানুষের আয় বাড়ছে না। কিন্তু সরকারি হিসাবে বিদায়ি সেপ্টেম্বর মাসেও মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮.৩৬ শতাংশ ছিল, যা আগস্ট মাসে ছিল ৮.২৯ শতাংশ। অর্থাৎ মাসিক ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তথ্য-উপাত্ত দেখায় যে বাসাভাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয়ের চাপ বেড়েছে। অন্যদিকে সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ওপরে অবস্থান করায় বোঝা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার বহাল রেখে মূল্যস্ফীতি কমানোর নীতির কাঙ্ক্ষিত ফল এখনো আসেনি। ব্যবসা-অর্থনীতিতে মন্দা থাকলে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় না। ২০২৫ সালের সাময়িক হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশের কম। এই হার আগের কয়েক বছরের ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশ কম। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি বড়জোর ৪.৮ শতাংশ হতে পারে বলে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে। কর বিশেষজ্ঞ ও এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেসের পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণের আগে অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে মাথায় নিয়ে করতে হয়। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পদ্ধতিই বাস্তবসম্মত নয়। সিগারেট খাতের আয় না বাড়লে রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো। শুধু নীতি নির্ধারণ দিয়েই এই আদায় হয়েছে, এতে কোনো প্রচেষ্টা নেই।’ দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বলছেন, সার্বিক অর্থনীতির গতিই মন্থর। এখানে প্রবৃদ্ধি কমবে, রাজস্ব কমবে এটাই স্বাভাবিক। একটি অস্থির সময়ের অর্থনীতি স্বাভাবিক সময়ের মত উচ্চ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটবে—এটা ভাবা বোকামি। তাঁরা জানান, সামনেই নির্বাচন। ওই সময় পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করছে। রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সার্বিক ব্যবসা ও অর্থনীতিতে একটা প্রাণচাঞ্চল্য আসতে পারে। তখন ব্যবসা-বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি গতি পেলে রাজস্ব আয়ও বাড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের উৎপাদন খাতের অন্যতম শীর্ষ শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রথীন্দ্রনাথ পাল বা আরএন পাল বলেন, ‘সারা দেশের সামগ্রিক উৎপাদন ও ভোগ কমে গেছে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আগে যাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি ছিল, এখনো তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি। আর যাদের ক্রয়ক্ষমতা কম ছিল, এখন আরো কমেছে। আমরা এ বিষয়টি টের পাচ্ছি। যদি চাহিদা কম থাকে তাহলে উৎপাদন কম হয়। তখন আবশ্যিকভাবে বিক্রি কমে যাবে, যার ফলে রাজস্ব আদায়ও স্বাভাবিকভাবেই কমবে। সরকারের ডলারসংক্রান্ত নীতির কারণে এখন আমদানিও কমেছে। ব্যাংকিং খাতের বর্তমান ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাংকগুলো এখন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই হিসাবী। একটা বিনিয়োগ হলে সেখানে বেচাবিক্রি হয় এবং রাজস্ব বাড়ে। আর্থিক ও ব্যাবসায়িক লেনদেন কমে যাওয়ায় সরকার রাজস্ব ঘাটতিতে পড়েছে।’ বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের টার্নওভার বাড়বে, রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। আয় না বাড়লে ট্যাক্স আসবে কিভাবে? দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে বিনিয়োগ হয় না। এ ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী বিনিয়োগের আগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেন। সরকার এই খাতে কোনো সহায়তা করবে কি না বুঝতে চান। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ঘোষণা করেছে। নতুন রাজনৈতিক সরকার এলে ব্যবসার ক্ষেত্রে করনীতি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সব বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয় সে বিবেচনায় বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ হবে। পরিস্থিতি ভালো না হলে ব্যবসায়ী বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করবেন কেন? সবাই হয়তো অপেক্ষা করছেন।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ