অন্ধ হইলে…


 এদেশের ট্যাপের পানি বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে বিপজ্জনক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত– সম্প্রতি প্রকাশিত ১৮০ দেশের পাইপলাইনে সরবরাহকৃত বা ট্যাপের পানির মান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ইয়েল ইউনিভার্সিটির ২০২২ সালের সূচকের এইরূপ চিত্র আমাদের উদ্বিগ্ন করিলেও বিস্মিত করিতেছে না। স্মরণ করা যাইতে পারে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায়ও উল্লেখ করা হইয়াছিল, বাংলাদেশে পাইপলাইনের পানির ৮০ শতাংশেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া আছে; পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য যে ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়। ইহাও বিস্মরণের সুযোগ নাই, চারি বৎসর পূর্বে– এই এপ্রিল মাসেই– দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ অধ্যায় তথা টিআইবি ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণার বরাত দিয়া অভিন্ন আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিল। সংস্থাটি বলিয়াছিল, ঢাকায় ৯৩ শতাংশ গ্রাহককে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ওয়াসার পানি পানের উপযোগী করিতে হয়। তখন এক সংবাদ সম্মেলন ডাকিয়া ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাঁহার সংস্থার সরবরাহকৃত পানিকে ‘সুপেয় ও বিশুদ্ধ’ বলিয়া দাবি করিয়াছিলেন। কিন্তু অন্ধ হইলেই যে প্রলয় বন্ধ হয় না, সাম্প্রতিক সূচকে তাহা পুনঃপ্রমাণিত। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যাইতেছে, ২০২২ সালের জন্য প্রস্তুতকৃত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইপিআই তথা এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্সে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পাইয়াছে ২৬ দশমিক ৯০, যাহার অর্থ হইল– দেশের ট্যাপের পানি সবচাইতে বিপজ্জনক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র তথা সিডিসিও বলিয়াছে, বাংলাদেশে ট্যাপ হইতে যে পানি বাহির হয়, তাহা পান করা নিরাপদ নহে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির সূচকে আরও বলা হইয়াছে, নিরাপদ পানীয়জলে প্রবেশাধিকারের দিক হইতে বাংলাদেশের অবস্থান সামগ্রিকভাবে ১২৮তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় পঞ্চম। শ্রীলঙ্কা ৪৬.৭০ স্কোর লইয়া এই অঞ্চলে প্রথম স্থানে আছে এবং পরবর্তী স্থানসমূহে আছে যথাক্রমে মালদ্বীপ, ভুটান ও আফগানিস্তান। প্রতিবেদন মতে, ইয়েল ইউনিভার্সিটির এই সূচকে অনিরাপদ পানীয়জলের সংস্পর্শে আসিবার কারণে প্রতি এক লক্ষ জনে প্রাণ হারানো, শারীরিক অক্ষমতা ও অন্যান্য ঝুঁকিতে পড়া মানুষের সংখ্যা মূল্যায়ন করিয়া পানীয়জলের গুণমান বিচার করা হইয়াছে। আমরা মনে করি, যদি বিশ্বব্যাংক ও টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনসমূহের ভিত্তিতে কালবিলম্ব না করিয়া যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইত, তাহা হইলে ইয়েল ইউনিভার্সিটির সূচকে আমাদের অবস্থা এতটা শোচনীয় হইত না। স্মরণ করা যাইতে পারে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দেওয়া বর্তমান শাসক দলের ইশতেহারে নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহের সুবিধা শহরের বাহিরে পল্লি অঞ্চলেও নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু যথায় রাজধানীর মানুষদেরই একটা বিরাট অংশ নিরাপদ পানি হইতে বঞ্চিত, তথায় পল্লি অঞ্চলে পাইপলাইনের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহের উক্ত প্রতিশ্রুতি যে কেতাবেই থাকিবে, উহা বুঝিতে কাহারও বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই। মনে রাখিতে হইবে, ঢাকাসহ প্রায় সমগ্র দেশেই নদনদী, জলাশয়সহ পানির ভূ-উপরিস্থ অধিকাংশ উৎস নানা কারণে দূষিত, আবার অতিব্যবহারের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনক মাত্রায় হ্রাস পাইবার পাশাপাশি দেশের অনেক স্থানে সুপেয় পানির এ উৎসও আর্সনিকসহ বিভিন্ন কারণে দূষিত হইয়া পড়িতেছে। এই সকল বিপদ লইয়া বারংবার আলোচনা হইলেও উহা দূর করিতে সরকারের তরফ হইতে অদ্যাবধি জোরদার ও কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় নাই। ঢাকা ওয়াসা নদনদীর পানি যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিশোধনের দাবি করিলেও জরাজীর্ণ সরবরাহ লাইনের কারণেও গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছাইবার পূর্বে উক্ত পানি দূষিত হওয়া অসম্ভব নহে। যাহাই হউক, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের প্রত্যাশা আলোচ্য প্রতিবেদনকে বিবেচনায় লইয়া সরকার অবিলম্বে উক্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তৎপর হইবে। সচেতন মহলকেও নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকার লইয়া সোচ্চার থাকিতে হইবে বলিয়া আমরা মনে করি।