অবর্ণনীয় দুর্ভোগের নগরী চট্টগ্রাম


চট্টগ্রাম নগরীর প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ এলাকার মানুষ চারদিন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। সোমবার দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। নগরীর প্রাসাদোপম বাড়ি কিংবা শপিংমলের সামনে রাস্তায় জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য দেখা গেছে। বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বাড়ির ভেতরে কোমর থেকে বুক পানিতে অবস্থান করে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে হাজার পরিবারকে। শ্রমজীবী ও কর্মজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করছেন। চান্দগাঁও থানা ভবনের নিচতলা পানির নিচে। জেলা পুলিশ লাইনেও পানি আর পানি। এখানে নৌকায় যাতায়াত করতে দেখা গেছে বাসিন্দাদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অলিগলি, মার্কেট, কাঁচাবাজার, দোকানপাট সব পানির নিচে। অতীতে এমন দুর্ভোগ আর দেখেননি নগরবাসী। এদিকে শুধু চট্টগ্রাম মহানগরী নয়, ১৬টির মধ্যে অন্তত ৬ উপজেলায় বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে বন্যা। এসব উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। রাস্তাঘাট, খেতের ফসল, পুকুর, মাছের ঘের ডুবে গেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জেলা প্রশাসন ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস, যা ৩০ বছরের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ২১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা জানান, আগস্ট মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৫৩০ দশমিক ৬ মিলিমিটার। কিন্তু গত ছয় দিনেই ৫৪৭ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। নগরীর বেশিরভাগ এলাকা সোমবারও ছিল পানির নিচে। বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় নাওয়া-খাওয়া ছিল বন্ধ। অনেক পরিবারের শিশু-বৃদ্ধ থেকে সবাই খাটের ওপর নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। করতে পারছেন না রান্নাবান্না। জরুরি প্রয়োজন এমনকি ডাক্তারের কাছেও যেতে পারছেন না রোগীরা। জলাবদ্ধতা কবলে রয়েছে বহদ্দারহাট, বাদুড়তলা, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, কাপাসগোলা, চকবাজার, বাকলিয়ার বিভিন্ন এলাকা, ফিরিঙ্গিবাজারের একাংশ, কাতালগঞ্জ, শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা, কে বি আমান আলী রোড, চান্দগাঁওয়ের শমসের পাড়া, ফরিদার পাড়া, মুন্সী পুকুর পাড়, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহরসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকা। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় জমে থাকা পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অনেক সড়কে বাস-মিনিবাস কিংবা প্রাইভেট গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা চলছে না। কেবল রিকশায় ভরসা। জোয়ারের ফলে আগ্রাবাদ, বন্দর, ইপিজেডের বিভিন্ন এলাকায় পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। বাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়েছে। দুই নম্বর গেট মুরাদপুর ও চকবাজার ব্যস্ততম সড়কের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানির স্রোত। এসব এলাকার বাসিন্দারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কোনো রকমে খেয়ে না-খেয়ে জীবন কাটছে বাসিন্দাদের। এদিকে পটিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, হাটহাজারী, লোহাগাড়া, সন্দ্বীপ, বোয়ালখালী ও রাউজান উপজেলার নিচু এলাকায় লোকালয়ে পানি উঠে গেছে। এসব উপজেলার হাজার হাজার বাসিন্দা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পটিয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে পৌরসভার ৫-৬ টি ওয়ার্ড যেখানে কখনো বর্ষা মৌসুমে পানি ওঠেনি সেসব ওয়ার্ডও তলিয়ে গেছে। মাঠে চসিকের জলাবদ্ধতা পর্যবেক্ষণ টিম : নগরীর জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও দ্রুত বদ্ধ পানি অপসারণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) একটি টিম। চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে এ টিম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করেছে সোমবার। এদিকে চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বিভিন্ন ওয়ার্ডের নয় হাজার পানিবন্দি মানুষকে শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন। চসিকের কর্মকর্তারা জানান, সোমবার দুপুরে জলাবদ্ধতা পর্যবেক্ষণ টিম বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ফুলতলা, বাড়ইপাড়া, এনায়েতবাজার, তিনপোলের মাথা, নিউমার্কেট, স্টেশন রোড, কাপাসগোলাসহ যেসব স্থানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সেসব স্থানে তাৎক্ষণিক সেবক, এক্সকেভেটর ও লং বুম ব্যবহার করে পানিপ্রবাহ সচল করার কাজ চেষ্টা করেন। এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান ব্যাহত : জলাবদ্ধতা ও বন্যার কারণে চট্টগ্রামে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এর আশপাশের এলাকায় পানি জমে যাওয়ায় সোমবার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা স্কুলে যেতে পারেননি। এ কারণে নগরী ও উপজেলার ৮০০ মাধ্যমিক এবং ১৯৫ প্রাথমিক স্কুল অঘোষিতভাবে বন্ধ থাকে। এদিকে পানি না কমলে আজ মঙ্গলবারও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকার কথা রয়েছে। যদিও মঙ্গলবার মহানগর এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা জারি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এ প্রসঙ্গে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শহীদুল ইসলাম বলেন, পানি সরে না গেলে মঙ্গলবারও এসব বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। তবে অন্যান্য বিদ্যালয়ের কার্যক্রম যথারীতি চলমান রয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তম খীসা বলেন, উপজেলার কোনো বিদ্যালয়ে পানি থাকলে সেগুলোর শ্রেণি কার্যক্রমও বন্ধ রাখা হবে।