অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার লড়াই


সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে নিট রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। তবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতো অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে দেশের নিট রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আবার বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে এই রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে। গত সেপ্টেম্বরে প্রথম ২৬ দিনে রিজার্ভ কমেছে (ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি) ২ বিলিয়ন ডলার। একই মাসে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ছিল গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং এ ধারা তিন মাস ধরে চলছে। একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সর্ববৃহৎ ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে রপ্তানি কমেছে এক-তৃতীয়াংশ এবং ইউরোপের বাজারে ১৪.৫০ শতাংশ। দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ যায় এ দুই বাজারে। বিগত অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ২৭ শতাংশ। সবকিছু মিলিয়ে ধরে নেওয়া যায় চলতি বছরের শেষ তিন মাসে রিজার্ভ ক্ষয় (ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি) ৭-৮ বিলিয়ন ডলার হবে। এতেই বছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে। এর পাশাপাশি আকুর পেমেন্ট সিস্টেমের ওপরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়াবে। অন্যদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারি এবং বেসরকারি খাত মিলিয়ে ১২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায় রয়েছে। ফলে বছর শেষে দেশে এক মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ অবশিষ্ট থাকবে কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ করা যায়। এর পাশাপাশি নিট রিজার্ভসহ আরও কয়েকটি শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় আইএমএফ-এর ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ভূরাজনৈতিক কারণেও কিছু শঙ্কা কড়া নাড়ছে। সেই আলোচনায় একটু পরে আসি। সরকারের আচরণ, উচ্চারণে অর্থনীতির এ সংকটের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নির্বাচন সামনে রেখে সরকার এ দুর্বলতা প্রকাশ করতে চাচ্ছে না। তারা বরং ব্যস্ত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন নিয়ে। প্রয়োজনে জোড়াতালি দিয়ে, অর্ধেক সম্পন্ন করে হলেও তারা এ প্রকল্পগুলো উদ্বোধনের চেষ্টা করছে। তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ বাড়ছে; যেমন: সদ্য উদ্বোধন করা অর্ধসম্পন্ন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। যদিও এ এক্সপ্রেসওয়ের সম্পূর্ণ কাজ আরও অনেক আগেই শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু এসব মেগা প্রকল্পের সময় এবং একই সঙ্গে বাজেট বৃদ্ধির (পড়ুন মেগা দুর্নীতি) কারণে প্রকল্প সম্পন্ন না হলেও অর্থনীতি খাদের কিনারে ঠিকই পৌঁছেছে এক্সপ্রেসওয়ের গতিতেই। একটা ছোট উদাহরণ দেই-‘দোহাজারী-ঘুমধুম রেল প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় ১৮০০ কোটি টাকা থাকলেও এখন তা ১০ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।’ মাঝে কিছুদিন বিশ্ব মন্দা, করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর দায় চাপিয়ে অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে সরকার কথা বলেছে। সেসময় প্রধানমন্ত্রীও তার বক্তব্যে সংকটের কথা স্বীকার করেছেন এবং কৃচ্ছ্রসাধনের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তার সরকার সেই পরামর্শ মেনেছে বলে মনে হয়নি। কেননা এ সংকটের মধ্যেও খিচুড়ি রান্না শেখার মতো বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রমোদভ্রমণ যেমন থামেনি, তেমনই সমানতালে চলেছে দুর্নীতি। সেই ফিরিস্তি এখানে লিখতে গেলে মূল আলোচনা করা যাবে না। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি কর্মকর্তাদের (যারা সরাসরি নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় যুক্ত) নানা উপহার দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। সংকটের মধ্যেও চলছে সরকারের ‘গাড়িবিলাস’। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কিনেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। ডিসি-ইউএনওদের সরকার দিচ্ছে নতুন গাড়ি। তাদের জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি কেনা হচ্ছে, যার জন্য ব্যয় হবে ৩৮০ কোটি টাকা। ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলার ডিসিরা পাবেন নতুন গাড়ি। আর ইউএনওদের জন্য কেনা হচ্ছে ২০০টি গাড়ি। শর্ত শিথিল করে তাদের ২৭০০ সিসির (ইঞ্জিনক্ষমতা) গাড়ি দেওয়া হচ্ছে, যা গ্রেড-১ ও ২ (সচিব ও অতিরিক্ত সচিব) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের প্রাধিকার। এজন্য সরকার গাড়ি কেনার ব্যয়সীমাও বাড়িয়েছে। এখন ৯৪ লাখ টাকার বদলে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি কেনা যাবে। এদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলীরাও ৪৩৩টি গাড়ি চেয়েছেন। পুলিশও গাড়ি কেনার জন্য চেয়েছে ২২৬ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের পাহাড় জমা হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে। বিদায়ি অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ বিলিয়ন ডলার। আরেকদিকে চলছে স্বজনতোষী নীতি। ১৪ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো দেওয়াই হয়েছে সরকারের কাছের ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোকে। আর তাই এ টাকার বেশির ভাগই গেছে তাদেরই পকেটে। অনেক সমালোচনা থাকার পরও সরকার এ প্রকল্পগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে, এমনকি সংসদে আইন পাশ করে ইনডেমনিটি দিয়েছে একমাত্র স্বজনতোষী নীতির কারণে। বলাবাহুল্য, অর্থনীতির এ মহাসংকটেও এ হরিলুট চলছেই। ব্যাংকে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর ঋণখেলাপিদেরই নতুন করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে; কখনো নামে, কখনো বেনামে, কখনো শুধু বিবেচনায় আবার কখনো বিশেষ বিবেচনায়। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ঋণ না পেলেও বন্ধ কারখানার নামে চলে যাচ্ছে ৭০০ কোটি টাকার ঋণ। এ ব্যবসায়ীরা আবার নিজেরা ব্যাংকের মালিক। আবার এ ব্যাংকের মালিকরাই সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি। বেশির ভাগ ব্যাংক ভুগছে তারল্য সংকটে। সরকারও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের চাহিদা মেটাতে টাকা ছাপিয়ে যাচ্ছে। শুরুতেই বলেছি রিজার্ভ সংকটের কথা। ফলে টাকার মান কমছে প্রতিনিয়ত। বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। সরকার যে কিছুই করছে না, তা নয়। সরকার নানা উপায়ে জনগণের কাছ থেকে টাকা তোলার চেষ্টা করছে। এজন্য কখনো করারোপ করছে, কখনো লোভনীয় স্কিম অফার করছে। সম্প্রতি সরকার বেসরকারি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি তহবিল এবং শ্রমিকদের লভ্যাংশের ওপর ২৭.৫ শতাংশ করারোপ করেছে। ফ্রিল্যান্সারদের রেমিট্যান্সের ওপর ১০ শতাংশ করারোপ করেও ডলার আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কায় তা বাতিল করেছে। অন্যদিকে সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মতো লোভনীয় অফার সামনে এনেছে। স্কিমটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে জনগণের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয় এবং পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে স্কিমগ্রহীতাকে এক টাকাও ফেরত দিতে না হয়। এমনকি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ এর ১৪ (ঘ)-এ বলা হয়েছে, ‘সরকার কর্তৃক বাধ্যতামূলক করিয়া সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত, প্রাথমিকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি স্বেচ্ছাধীন থাকিবে’। অর্থাৎ ‘সরকার চাইলে যে কোনো সময় এ স্কিম বাধ্যতামূলক করতে পারবে’-এমন বিধান রাখা হয়েছে। বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব চাপ প্রয়োগ করছে। এর পাশাপাশি রয়েছে মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শ্রম অধিকারসহ আরও কিছু বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্ব চাপ অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব এবং র‌্যাবের সাবেক বর্তমান ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা করেছে। চলতি বছরের মে মাসে ঘোষণা করেছে ভিসানীতি। ভিসানীতিতে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে যারাই বাধা প্রদান করবে, তারাই এ নীতির আওতায় নিষেধাজ্ঞার শিকার হবেন। একই রকম কথা বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অস্ট্রেলিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সুবিধা বাতিল হলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে ১২ শতাংশ শুল্কারোপ হবে। শুরু থেকেই সরকার পশ্চিমা বিশ্বের এ অবস্থানের কড়া সমালোচনা করে আসছে। কয়েকদিন আগে সরকারপ্রধান যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে এক বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পালটা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও এবারই প্রথম না, এর আগেও বেশ কয়েকবার প্রধানমন্ত্রী এ পালটা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা বলেছেন। সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যে মনে হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটা নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে এবং সেটি সম্ভবত জিএসপি সুবিধা বাতিল কিংবা আরও বড় পরিসরে হলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। প্রথমেই বলেছিলাম, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সরকারের বিরোধ অব্যাহত থাকলে এবং জিএসপি সুবিধা বাতিল হলে বাংলাদেশের পোশাক খাত, তথা সামগ্রিক অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধসে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, অর্থনৈতিক মহাবিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়েও সরকার ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই সুরে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মানবাধিকারের কথা বলছে; এর বিরোধিতা করার কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে তো মনে হয় না। আর ভিসানীতি আরোপকে কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ মনে করা হচ্ছে, সেটিও বোধগম্য নয়। যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে কাকে প্রবেশ করতে দেবে, সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সরকারি দলের নেতাদের কথায় মনে হতেই পারে তারা আরেকটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান এবং আয়োজনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আর কেবল ক্ষমতার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে রীতিমতো জিহাদ ঘোষণা করে সরকার দেশের অর্থনীতিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাকিব আনোয়ার : অ্যাক্টিভিস্ট, প্রাবন্ধিক mnsaqeeb@gmail.com