অর্থ সংকটে এফডিআর ভেঙে খাচ্ছে বাপেক্স


চরম অর্থ সংকটে পড়েছে সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম প্রোডাকশন অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি (বাপেক্স)। নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য কোম্পানির হাতে পর্যাপ্ত নগদ টাকা নেই। আইন অনুযায়ী গ্যাস বিক্রির ওপর ভ্যাট বাবদ পাওয়া অর্থ ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যথায় মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা দিতে হয়। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে থাকা এফডিআর ভেঙে এসব অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে বাপেক্সকে। এ অবস্থায় সরকারি কোষাগারের পাওনা পরিশোধ, টেকসই অনুসন্ধান, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা এবং বাপেক্সের আর্থিক তারল্য সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে কোম্পানিটি। ২৩ জুলাই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব এসব কারণ উল্লেখ করে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে (বিজিডিসিএল) একটি চিঠি দেয়। এটি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনকেও (পেট্রোবাংলা) দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিজিডিসিএলসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে গ্যাস বিক্রির বিলসহ বকেয়া রয়েছে ১১৪ কোটি টাকা। বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি মে মাসের ওভারহেড মার্জিন বাবদ ৭ কোটি ১৩ লাখ এবং ভ্যাট বাবদ ৪ কোটি ৯৭ লাখসহ ১২ কোটি টাকার বিল পরিশোধ করছে না। এ প্রসঙ্গে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওই চিঠিতে বলেন, গ্যাস বিল যথাসময়ে না পাওয়ায় বাপেক্সে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া অর্থ আইন ২০২০-এর ধারা ৬০ অনুযায়ী প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রির ওপর ভ্যাট বাবদ অর্থ ৯০ দিন অতিক্রমের আগে পরিশোধের আইন থাকা সত্ত্বেও গত বছরের আগস্টের বিল থেকে অদ্যাবধি ভ্যাট বাবদ কোনো অর্থ আপনাদের পক্ষ থেকে পরিশোধ হয়নি। উপরন্তু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাপেক্স জরিমানা পরিহারের লক্ষ্যে এফডিআর নগদায়ন করে নিয়মিতভাবে ভ্যাট পরিশোধ করে আসছে। চিঠিতে বিজিডিসিএলকে বলা হয়, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে বাপেক্সে ভ্যাট বাবদ খুবই কম অর্থ পরিশোধ করছে। এটি ভ্যাট আইন পরিপন্থি। এ বিষয়ে সম্প্রতি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানেরও হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শোয়েব। তিনি গণমাধ্যমে জানান, ২০২২ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্দেশনা অনুযায়ী, বাপেক্স তার উৎপাদিত গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে সরবরাহ করে। তার মতে, নতুন কূপ খনন ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের জন্য বাপেক্সের পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজন হয়। সময়মতো বিল পরিশোধ না করার কারণে এই ফান্ড সংকট তৈরি হয়েছে। এদিকে লোকসানে চললেও বাপেক্স কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বোনাস দিচ্ছে বলে প্রশ্ন উঠেছে। বাপেক্সের হিসাব বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শ্রীকাইল ৪, তিতাস ১, ২, ৫, ১০ এবং শাহবাজপুর ৪ নম্বর কূপের ওয়ার্কওভার কাজ পরিচালনার জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চারবার বিশেষ বোনাস (মূল বেতনের সমপরিমাণ) দেওয়া হয়। অস্থায়ী শ্রমিকদেরও বিভিন্ন সময় জনপ্রতি ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা বোনাস দেওয়া হয়। শুধু বিশেষ বোনাস নয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও পানির বিল বাবদও অর্থ নিচ্ছেন বাপেক্স থেকে। সম্প্রতি সরকারি এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। অভিযোগ আছে, বাপেক্সের একটি সিন্ডিকেট বিশেষ বোনাসের নামে সরকারি অর্থ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। এমনকি ওয়ার্কওভারের (পুরোনো কূপ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ) মতো নিয়মিত কাজের জন্যও এই সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিশেষ বোনাস নিয়েছেন। অথচ কিছুদিন পরপর বলা হচ্ছে, এটি সরকারের একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাপেক্সের এক কর্মকর্তা বলেন, পুরোনো গ্যাসকূপে ওয়ার্কওভারের মূল কাজ করেন খনন বিভাগের লোকজন। ওই কাজে সহায়তা লাগে প্রকৌশল বিভাগের। এছাড়া দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করেন আরও অর্ধশত অস্থায়ী শ্রমিক। কিন্তু বিশেষ বোনাস দেওয়া হয়েছে বাপেক্সের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। আর অস্থায়ী শ্রমিকদের হাজিরাও প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে। জানা যায়, একটা পুরোনো কূপে ওয়ার্কওভার কাজ করতে সব মিলিয়ে ৬০-৭০ জনের লোকবল দরকার হয়। কিন্তু বিশেষ বোনাস দেওয়া হয়েছে ৩৬০ জনের বেশি স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। অভিযোগ আছে, ওয়ার্কওভার কাজের জন্য কোনো কোনো কূপে অস্থায়ী শ্রমিক দেখানো হয়েছে ১০৫-২১৩ জন। ওয়ার্কওভার কাজে সবার সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও সবাইকে বিশেষ বোনাস দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব বলেন, যে কোনো অর্জনই কোম্পানির অর্জন হিসাবে ধরা হয়। এজন্য কোম্পানির সবাইকে বিশেষ বোনাস দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বোনাস দেওয়ার প্রচলন আগে থেকেই আছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাপেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা খাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে ১০ কোটি ২০ লাখ ১ হাজার ৯৭৯ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে নিয়েছেন। বাপেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওই টাকা ফেরত দিতে বলেছে সিএজি কার্যালয়। এ টাকা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ও। নিরীক্ষাকালে বাপেক্সের বিভিন্ন রেজিস্টার ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করা হয়। চলতি বছর এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ বোনাস এবং বিদ্যুৎ ও পানির বিলের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় বলেছে, ওয়ার্কওভার বাপেক্সের নিয়মিত কাজ। এই কাজের জন্য সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্মানি বা বিশেষ বোনাস পেতে পারেন না। বাপেক্সের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, যে বছর বিশেষ বোনাস ও বাসাবাড়ির পানি-বিদ্যুতের বিল দেওয়া হয়েছে, সেই বছর (২০১৬-১৭) বাপেক্সের নিট লোকসান হয় ২৬৩ কোটি ৩২ লাখ ৯২ হাজার ২৯ টাকা। জানা যায়, বাপেক্স মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিমাসে ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ২০০ ইউনিট পানির বিল, উপমহাব্যবস্থাপকদের ৩৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১৫০ ইউনিট পানির বিল, ব্যবস্থাপকদের ৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১০০ ইউনিট পানির বিল, উপব্যবস্থাপকদের ২৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১০০ ইউনিট পানির বিল, সহকারী ব্যবস্থাপকদের ২৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১০০ ইউনিট পানির বিল, সহকারী অফিসারদের ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও ১০০ ইউনিট পানির বিল এবং অন্যান্য কর্মচারীকে মাসিক ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ও মাসিক ১০০ ইউনিট পানির বিল দেওয়া হচ্ছে।