অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন: সারা দেশ রণক্ষেত্র, নিহত ৯১


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সরকার পতনের একদফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। এ সময় পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত ৯১ জন নিহত হয়েছেন। কয়েকশ গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। নিহতদের মধ্যে ১৪ জন পুলিশ সদস্য। এছাড়া শিক্ষার্থী-শিক্ষক, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও ছাত্রদল নেতাও রয়েছেন। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলা চালিয়ে ১৩ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় ১০, লক্ষ্মীপুরে ৮, ফেনীতে ৭, নরসিংদীতে ৬, সিরাজগঞ্জে ৯, বগুড়ায় ৫, কিশোরগঞ্জে ৪, রংপুরে ৪, সিলেটে ৪, মাগুরায় ৪, মুন্সীগঞ্জে ৩, পাবনায় ৩, শেরপুরে ৩, কুমিল্লায় এক পুলিশসহ ২ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া বরিশাল, জয়পুরহাট, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও হবিগঞ্জে একজন করে মারা গেছেন। এদিকে দিনভর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের সময় স্থানীয় সংসদ-সদস্য, পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়, থানা ও ইউএনও অফিসও ভাঙচুর করা হয়। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও বিএনপির কার্যালয়েও ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- কিশোরগঞ্জে নিহত ৪, আহত অর্ধশত : বেলা ১১টার দিকে আন্দোলনকারীরা শহরের পুরান থানা চৌরাস্তা মোড়ে জমায়েত হয়। সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় তারা স্টেশন রোডে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেয়। এতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা যায়। একপর্যায়ে গোটা শহর আন্দোলনকারীরা নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপর সদর মডেল থানা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে হাজার-হাজার নারী-পুরুষ শিক্ষার্থী। পরে বিক্ষোভকারীরা শহরের খরমপট্টি এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। এ সময় তার বাসার কেয়ারটেকার অঞ্জনা (৩৫) ও অজ্ঞাত পরিচয় যুবক (৪০) নিহত হয়েছেন। এছাড়া সংঘর্ষের সময় আরও দুজন মারা গেছেন। তারা হলেন-বিকাশ ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ (৫০) এবং অজ্ঞাত পরিচয় (৩৫) যুবক। এদের মধ্যে অজ্ঞাত পরিচয় ওই যুবক গুলিতে মারা গেছেন। তার লাশ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। এছাড়া ছাত্রলীগ-যুবলীগ, আন্দোলনকারী ও সংবাদকর্মীসহ অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। রংপুরে কাউন্সিলরসহ নিহত ৪, আহত অর্ধশত : আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে রংপুর সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পশুরাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারাধন রায় হারা (৪৮) ও তার ভাগনে আওয়ামী লীগ কর্মী শ্যামল চন্দ্র রায়সহ (২২) চারজন নিহত হয়েছেন। অপর দুজন হলেন-সদর থানা আওয়ামী লীগের কর্মী মাসুম মিয়া (২৪) ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য খায়রুল ইসলাম সবুজ (৩৮)। নিহত চারজনই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মী। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ সময় সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা গুরুতর। দুপুরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পালটাধাওয়ার পর নগরীর সিটি করপোরেশনের সামনের অংশ, সুপার মার্কেট, জাহাজ কোম্পানি ও পায়রা চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকা দখলে নিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তাদের নগরীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান করতে দেখা গেছে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনের অফিসগুলো আগুন ধরিয়ে দেয়। পাবনায় নিহত ৩ গুলিবিদ্ধসহ আহত অর্ধশত: বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শহরের আব্দুল হামিদ সড়কের ট্রাফিক মোড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে আওয়ামী লীগ নেতা আবু সাইদ ওরফে সাইদ চেয়ারমানের নেতৃত্বে গুলিবর্ষণ করা হয়। এ সময় দুই শিক্ষার্থীসহ ৩ জন নিহত ও কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন-সদর উপজেলার বলরামপুর গ্রামের দুলাল উদ্দিনের ছেলে জাহিদুল (১৮) ও দোগাছি গ্রামের আবুল কালামের ছেলে স্থানীয় গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মাহাবুল (১৬)। কালাম আনসার বিবিপি অফিসের গাড়িচালক। আরেকজনের নাম জানা যায়নি। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. জাহিদুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনার পর সাইদ চেয়ারম্যানের গাড়িসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জানালা ও গ্লাস ভাঙচুর করা হয়। পুরো শহর দখলে নেন আন্দোলনকারীরা। দুপুর আড়াইটার দিকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের আবারও সংঘর্ষ হয়। এ সময় কমপক্ষে ২০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। অধিকাংশই আন্দোলনকারী। ভোলায় নিহত ১, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৩০ : বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভোলার সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন ইলিশা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা শহরের বিভিন্ন সড়ক পদক্ষিণ করে বাংলাস্কুল মোড়ে এলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ অফিস, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা অফিসে আগুন দিয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়, পৌরসভা অফিস চত্বর এবং বাংলাস্কুল মাঠে ৪০-৫০টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় মো. জসিম নামে একজন ছাতি ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। তিনি নবীপুরের আবু তাহেরের ছেলে। নিহতের ভাই সবুজ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া ৫ গুলিবিদ্ধসহ ৩০ জন আহত হয়েছেন। মাগুরায় ছাত্রদল নেতাসহ ৪ জন নিহত : সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শহরের পারনান্দয়ালী ব্যাপারীপাড়া মোড়ে জড়ো হয় আন্দোলনকারীরা। এ সময় তাদের বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রাব্বিসহ চারজন নিহত হয়েছেন। অন্যরা হলেন-জেলার শ্রীপুর উপজেলার গোলাম মোস্তফার ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফরহাদ এবং মহম্মদপুর উপজেলার আমিনুর রহমান ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী সুমন শেখ ও আহাদ মোল্যা। সংঘর্ষে চার পুলিশ ও সাংবাদিকসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ভাঙচুরের পাশাপাশি শহরের ভায়নার মোড়ে জামান অ্যান্ড দত্ত পাম্পে এবং পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সিলেটের গোলাপগঞ্জে নিহত ৪, আহত অর্ধশত : আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। গোলাপগঞ্জ উপজেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিজিবি ও পুলিশের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক লোক। নিহতরা হলেন-উপজেলার বারকুট গ্রামের মো. মকবুল আলীর ছেলে ব্যবসায়ী তাজউদ্দিন (৪৩), উপজেলার শিলঘাটের বাসিন্দা সানি আহমদ (১৮) এবং নাজমুল ইসলাম। অপরজনের পরিচয় পাওয় যায়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার জানান, তিনজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। আরেকজন হাসপাতালে মারা গেছেন। এছাড়া গুলিবিদ্ধ আরও ৩ জনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। বগুড়ায় দুই শিক্ষার্থীসহ চারজন নিহত : থানা ও পুলিশের ওপর হামলার সময় গুলিতে বগুড়া সদরে তিনজন ও দুপচাঁচিয়ায় একজন নিহত হয়েছেন। তিনজনের লাশ বগুড়া শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ও একজনের কাহালুর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নিহতরা হলেনÑ কাহালু উপজেলার বীরকেদার ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া গ্রামের সামসুল ইসলামের ছেলে নওগাঁর বদলগাছীতে বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের অনার্স (ইতিহাস) পঞ্চমবর্ষের ছাত্র মনিরুল ইসলাম মনির (২২) ও গাবতলীর জিল্লুর রহমান (৪৫)। অপর দুজনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। এদের একজন শহরের সাতমাথায় ডাকবাংলোর সামনে, একজন ৩ নম্বর রেল গুমতির কাছে, একজন শহরের অন্যত্র এবং অপরজন দুপচাঁচিয়ায় নিহত হয়েছেন। বগুড়া শজিমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আবদুল ওয়াদুদ জানান, গুলিতে নিহত তিনজনের মরদেহ মর্গে রয়েছে। হাসপাতালে ২২ জন ভর্তি হয়েছেন। তার ধারণা, গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. শফিক আমিন কাজল বলে, এখানে দুজন ভর্তি হয়েছেন। কাহালুর বীরকেদার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম হোসেন জানান, দুপচাঁচিয়ায় পুলিশের গুলিতে তার এলাকার কলেজছাত্র মনিরুল ইসলাম মনির নিহত হয়েছেন। তার লাশ নিয়ে মিছিল শেষে দাফনের জন্য বাড়িতে আনা হয়েছে। লাশ পুলিশকে দেওয়া হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বগুড়ায় বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া-পালটাধাওয়া ও সংঘর্ষে শতাধিক পুলিশ ও আন্দোলনকারী আহত হন। শহরের বড়গোলা এলাকায় সদর উপজেলা সহকারী কমিশনানের (ভূমি) কার্যালয়ে কয়েক দফা হামলার পর আগুন দেয়া হয়। হামলাকারীরা একই এলাকায় সিটি ব্যাংকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। দত্তবাড়ি এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহনের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, আসবাবপত্র বাহিরে এনে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এছাড়া শহরের শিববাটি এলাকায় বগুড়া সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুর বাসভবনে হামলা ও তার ব্যক্তিগত গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। শেরপুরে পুলিশের গাড়ি চাপায় নিহত ৩ : শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বিকেলে শহরের খড়মপুর এলাকায় বিক্ষোকারীদের ওপর পুলিশের দ্রুতগামী গাড়ি উঠে গেলে তিনজন বিক্ষোভকারী চাপা পড়ে নিহত হয়। এ সময় শেরপুর শহরের কলেজ মোড়ে পুলিশের সুপারশপে ভাঙচুর ও মালামাল লুটপাট হয়। খোয়ারপাড় পুলিশের ট্রাফিক বক্স ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। পৌর নিউমার্কেটের আলিশান হোটেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। একই সময়ে নিউমার্কেটে অবস্থিত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শেরপুর-১ আসনের এমপি ছানুয়ার হোসেন ছানু ব্যক্তিগত কার্যালয় ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। পরে শহরের রঘুনাথ বাজারে অবস্থিত জেলা আনসার-ভিডিপি কার্যালয় ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন দুর্বৃত্তরা এবং সেখানে থাকা মোটরসাইকেলেও আগুন দেওয়া হয়। শহরের চকবাজারে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসও ভাঙচুর হয়েছে এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক হুইপ ও এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিউর রহমান আতিকের মাধবপুরে বাসাতেও ইটপাটকেট ছুড়া হয়েছে। এ ছাড়া শহরের নারায়নপুরে অবস্থিত পুলিশ সুপারের বাসভবনে এবং সদর থানাতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জে নিহত ৩: আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত ও কমপক্ষে দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে শতাধিক গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নেয়। শহরের সুপার মার্কেট, থানারপুর চত্বর, কৃষি ব্যাংক ও হাসপাতাল সড়ক এলাকায় তিন পক্ষের মধ্যে পালটাপালপি ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। বিকাল ৪টা পর্যন্ত এসব এলাকা গুলি, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এর মধ্যে চলে ধাওয়া-পালটাধাওয়া। নিহতরা হলেন- শহরের উত্তর ইসলামপুরের কাজী মতিন ফরাজীর ছেলে রিয়াজুল ফরাজী, একই এলাকার মো. সজল ও উত্তর ইসলামপুরের সিরাজ সর্দারের ছেলে ডিপজল। মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবু হেনা জামাল জানান, সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মধ্যে দুজন মৃত ছিলেন। বেলা ৪টা পর্যন্ত শতাধিক গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৭ জনকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি ও ২১ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিকাল পৌনে ৫টার দিকে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা জেলা বিএনপির কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালান। আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনকারীরা মুক্তিযুদ্ধ সংসদ ভাঙচুর করে। কুমিল্লা ও দেবিদ্বারে নিহত ২ : ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে থানায় আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র লুটপাট করে একদল দুর্বৃত্ত। এ সময় থানার ওসিসহ সব পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই পুলিশের কনস্টেবল এরশাদ হোসেন নিহত হন। হামলাকারীরা থানা কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে সব আসবাবপত্র এবং পুলিশের যানবাহন ভাঙচুর করে লন্ডভন্ড করে পালিয়ে যায়। নিহত কনস্টেবল এরশাদ শেরপুর জেলার বাসিন্দা। ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের একটি রেকার অগ্নিসংযোগ এবং একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনে ভাঙচুর করা হয়। দেবিদ্বার উপজেলা সদরে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক বাসচালক নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫০ জন। নিহত বাসচালাক আব্দুর রাজ্জাক রুবেল উপজেলার বারেরা এলাকার বাসিন্দা। কুমিল্লার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (দেবিদ্বার সার্কেল) শাহ মোস্তফা মো. তারিকুজামান বলেন, দুষ্কৃতকারীরা দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদে হামলা চালায়। এ সময় তারা ইউএনও’র কার্যালয়সহ বেশকিছু স্থাপনায় হামলা চালানোর চেষ্টা করে। একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে তারা। মেঘনা উপজেলার লুটেরচরে আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিয়ে দৌড়ে দেয়। দাউদকান্দিতে গৌরীপুর বাস স্টেশন থেকে দাউদকান্দি বিশ্বরোড পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আন্দোলনকারীদের দখলে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং সুন্দুলপুর ইউপি চেয়ারম্যান আসলাম মিয়াজিকে কুপিয়ে আহত করে। এ সময় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বরিশালে আ.লীগ নেতা নিহত : আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ধাওয়া-পালটাধাওয়া, সংঘর্ষে টুটুল চৌধুরী নামে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে শত শত রাউন্ড টিয়ার শেল, রাবার বুলেট এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। পালটা আক্রমণ হিসাবে পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছোড়ে আন্দোলনকারীরা। এ সময় বরিশাল সদর আসনের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামিম এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের বিভাগীয় কার্যালয়সহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি-প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও ৫০টির বেশি মোটরসাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জয়পুরহাটে নিহত কলেজছাত্র : পুলিশের গুলিতে মেহেদী হাসান হাসান বিশাল (২১) নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। জয়পুরহাট শহরের এলাকায় পাচুরমোর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় এ ঘটনা ঘটে। নিহত মেহেদী হাসান বিশাল জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার রতনপুরের মফিজুল সরকারের ছেলে। সে পাঁচবিবির বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আহত হয়। আহতদের মধ্যে ৬৭ জনকে জয়পুরহাটের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কেরানীগঞ্জে আ.লীগ নেতা নিহত : ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর এলাকায় গণপিটুনিতে কালিন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৫নং ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক ইসতি নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। তাদের মুমূর্ষু অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা এক পর্যায়ে তারানগর ইউপি চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ফারুক ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সিদ্দিকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। হবিগঞ্জে নিহত সেলুন কর্মচারী : শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় রিপন শীল (২৭) নামে এক সেলুন কর্মচারী নিহত হয়েছেন। তিনি শহরের অনন্তপুর এলাকার বাসিন্দা রতন শীলের ছেলে। এ ঘটনায় ২ শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। বেলা পৌনে ২টায় বৃন্দাবন সরকারি কলেজের সামনে থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বের হয়। তারা শহরের তিনকোণা পুকুরপাড় এলাকায় পৌঁছলে তাদের লক্ষ্য করে গুলি নিক্ষেপ করা হয়। তখন শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদ সদস্য মো. আবু জাহিরের বাসা ঘেরাও দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলছিল। এ সময় বেশ কিছু মোটরসাইকেল ও একটি দোকানে আগুন দেয়া হয়। চট্টগ্রামে সংঘর্ষ গুলি, নিহত ১ : কারো বুকে, কারো পায়ে লেগেছে গুলি। ছররা গুলিতে কারো শরীর হয়েছে ঝাজরা। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে কারো মাথা। রোববার বেলা ১২টার পর থেকে রক্তাক্ত ও মুমূর্ষু অবস্থায় একের পর এক আসতে থাকে আহতরা। অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে সংঘর্ষে পড়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে আহত হন তারা। তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। আর এখানেই কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিকভাবে দেখেই আহতদের দ্রুত পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে। এ কাজে সহযোগিতা করেন রেডক্রিসেন্টের একদল উদ্ধারকারী। বেলা ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় অন্তত ৯০ জনকে হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে ৫০ জনেরও বেশি ছিল গুলিবিদ্ধ। যাদের অধিকাংশ আন্দোলনকারী বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর অধিকাংশকে ভর্তি দেওয়া হয় ক্যাজুয়াল্টি ওয়ার্ডে। ওই ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ ও ছুরিকাঘাতে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এছাড়া যারা মাথায় ও হাড়ে আঘাত পেয়েছে তাদের পাঠানো হয় হাসপাতালের ২৬ নম্বর অর্থসার্জারি ও ২৮ নম্বর নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে। মেয়রের বাসভবনে হামলা সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে পথচারীর মৃত্যু। শনিবার রাতে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনে হামলা চলাকালে গুলিবিদ্ধ এক ব্যক্তি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। রাত ১০টার দিকে নগরীর পাঁচলাইশে এলাকায় অবস্থিত বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। নিহত মো. শহীদ নগরীর এক কিলোমিটার এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেতেন। নগরীর নিউমার্কেট, তিন পুলের মাথা, আন্দরকিল্লা, টাইগারপাস, কাজীর দেউড়িসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থিতদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে। এ সময় সরকার সমর্থিত অনেক নেতাকর্মীর হাতে দেখা গেছে হালকা ও ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল লাঠিসোঁটা ও ইটপাটেকল। বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ৫০ জন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। কক্সবাজারে নিহত ১ : গুলিবিদ্ধ হয়ে ১ জন আন্দোলনকারী নিহত ও ৮ জন আহত হয়েছেন। কক্সবাজার শহরে গুনগাছ তলায় এ গুলির ঘটনা ঘটে। নিহত ও আহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. আশিকুর রহমান। তবে তাৎক্ষণিক নিহত ও আহতদের পরিচয় পাওয়া যাইনি। নিহতের বয়স আনুমানিক ২২ বলে জানিয়েছেন তিনি। ঈদগাঁও উপেজলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা ৫টি পুলিশ বক্স ভাঙচুরসহ অন্তত ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে আন্দোলনকারীরা। এদিকে আন্দোলনকারীরা চলে যাওয়ার পর জেলা বিএনপির অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ ভাংচুর আগুন : টাঙ্গাইল : সংসদ-সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের বাসভবন, পৌরসভার মেয়র এসএম সিরাজুল হক আলমগীরের বাসভবন, পেট্রোল পাম্প ও হাইওয়ে রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্মিসংযোগ করেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করলে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এসব ঘটনায় একজন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়াও টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ও অ্যাডভোকেট বার সমিতি ভবন ভাঙচুর করেন আন্দোলনকারীরা। ময়মনসিংহ সড়কের সাবালিয়া এলাকায় আন্দোলনকারীদের মিছিলের ওপর দুর্বৃত্তরা গুলিবর্ষণ করে। এতে রাসিনুল খান নামক এক শিক্ষার্থীর পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। কালিহাতীতে আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর হয়। আন্দোলনকারীদের হামলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাহারুল ইসলাম তালুকদার আহত হন। কুষ্টিয়া : জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ট্রাফিক পুলিশ অফিস, বঙ্গবন্ধুর মুরাল, জেলা পরিষদ ভবনসহ বেশ কিছু স্থাপনায় হামলা ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে। এ সময় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ব্যক্তিগত অফিসও ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ দফায় দফায় টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ব্যর্থ হয়। এসব ঘটনায় তিনজন সংবাদকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এছাড়া পুলিশ আন্দোলনকারী ও পথচারীসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। গাইবান্ধা : দুপুরের দিকে শিক্ষার্থীরা ডিসি ও এসপি অফিসের সামনে গেলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। তারা আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে শতাধিক রাউন্ড টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও গুলিবর্ষণ করে। এতে অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, আহত হওয়ার খবর মিলেছে। আহতরা গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালসহ শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। চাঁদপুর : শহরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পালটাপালটি ধাওয়া ও সংঘর্ষে পুলিশ সাংবাদিক নারী শিক্ষার্থীসহ অর্ধশত আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত ১২ জনকে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুজনকে ঢাকায় রেফার করা হয় বলে জানা গেছে। ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) : আন্দোলনকারীদের সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ প্রায় শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় কমপক্ষে অর্ধশত আহত হয়। রোববার দুপুর ১২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড, জগনাথপুর এবং কালিকাপ্রসাদ এলাকায় এই সংঘর্ষ চলে। এ সময় আন্দোলনকারীরা কিছু বাড়িঘর দোকানপাট ভাঙচুর করেন। তবে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দেখা যায়নি। দুপুর দেড়টার দিকে ভৈরব থানা আক্রমণ করতে চেষ্টা করলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিলে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়। এ সময় পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ঠাকুরগাঁও ও পীরগঞ্জ : আন্দোলনকারীরা ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগ অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছেন। পীরগঞ্জে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অর্ধশত আহত হন। নড়াইল : স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও এক বৃদ্ধ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ সময় নারীসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। আন্দোলনকারীরা পুলিশের পিকআপভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেয়। রোববার বেলা ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত দফায় দফায় আন্দোলনকারী, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে এ সংঘর্ষ হয়। ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) : ছাত্র-জনতার একটি বিক্ষোভ মিছিল উপজেলা সদরে প্রবেশ করলে হাসপাতালসংলগ্ন কলেজ রোড এলাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী ও অজ্ঞাত নামা প্রায় ৩০-৪০ আন্দোলনকারী আহত হন। এর মধ্যে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারীর অবস্থা গুরুতর। পরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা পিছু হটলে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপজেলা সদরে প্রবেশ করে। এ সময় আন্দোলনকারীরা উপজেলা পরিষদ চত্বরের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, উপজেলা অডিটরিয়াম ও ফুলবাড়ী থানায় ব্যাপক ভাঙচুরসহ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে জানালার কাঁচ এবং উপজেলা পরিষদ চত্বরের বঙ্গবন্ধুর মুরাল ভাঙচুর করে। এসময় আন্দোলনকারীদের ইটের আঘাতে নাজমুল নামের এক সংবাদকর্মী আহত হন। নেত্রকোনা : পূর্বধলা উপজেলার নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা। শ্যামগঞ্জ বাজারে আন্দোলনকারীরা পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন। এ সময় পুলিশের অস্ত্র লুটপাটের অভিযোগ ওঠে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। এ সময় ৬ পুলিশ সদস্য আহত হন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সাথে কুড়পাড়, পারলা বাসস্ট্যান্ড, নাগড়া সাতপাই কলেজরোড এলাকায় ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পালটাধাওয়া হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়। কালিয়াকৈর (গাজীপুর) : ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় রোববার দিনব্যাপী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে রোববার আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ অফিস ও পুলিশ বক্সে আগুন, থানায় হামলার চেষ্টা এবং নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের নিচে থাকা কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করেছে। এ সময় তারা কালিয়াকৈর প্রেস ক্লাবে ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে গুলি চালায়। এ সময় কালিয়াকৈর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এদিকে উপজেলার সফিপুর আনসার একাডেমির ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে আনসার সদস্যদের সাথে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় আনসার সদস্যরাও তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশ ও আনসারদের গুলিতে শিশু শিক্ষার্থীসহ অন্তত শতাধিক আহত হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া : জেলা আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙচুর, জেল রোডের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভাঙচুর, আশুগঞ্জ থানায় হামলা, ৪৫টি মোটরসাইকেলে আগুন, বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগিয়েছে বিক্ষুব্ধরা। ধাওয়া-পালটাধাওয়া ও সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে শতাধিক আহত হয়েছেন। আহত সংবাদিককে উদ্ধার করতে গিয়ে কয়েকজন সাংবাদিক আহত হন। সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জ শহর ছাড়া বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায়ও সংঘর্ষে ২০-২৫ আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সংঘর্ষের সময় পুরাতন বাসস্টেশনের বিএনপি অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করা হয়। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কালীবাড়ি পয়েন্টে প্রথমে আন্দোলনকারীরা জড়ো হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র হাতে নিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়। পরে শহরের পুরাতন বাস-স্টেশন এলাকায় আন্দোলনকারীরা পুলিশকে ফুল দিয়ে বরণ করে। এ সময় সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একটি মিছিল পুরাতন বাস স্টেশন এলাকার দিকে গেলে উত্তেজনা দেখা দেয়। আন্দোলনকারীরা এ সময় অবস্থান নেন আরপিননগর ও তেঘরিয়া গলির মুখে। ওখানেই বাধে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। এ সময় সংঘর্ষে উভয়পক্ষের কয়েকজন আহত হন। ধামরাই (ঢাকা) : ধামরাইয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের দফায় দফায় ব্যাপক সংঘর্ষ ও ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয়পক্ষের অন্তত অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। এতে ঢাকার মহাসড়কের ধামরাই পৌরসভার ভুলিবিটা ওষুধি পাড়া ইউনিয়নের কালামপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়। উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কালামপুর অবস্থান নিলে পুরো এলাকা আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। মৌলভীবাজার : শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পালটাধাওয়া হয়েছে। এতে অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত ও গুলিবৃদ্ধ হয়েছেন দুজন। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পৌর শহরের চৌমুহনী পয়েন্টে আশামাত্রই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে। পরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ধাওয়া করে পুরো শহর। মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ফয়ছল জামান বলেন, ৩৪ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ছয়জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। চাঁদপুর : আওয়ামী লীগ অফিসে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর বাসার নিচতলায়, সড়ক ভবনে আগুন এবং ৭১ টিভি জেলা প্রতিনিধির ব্যক্তিগত অফিস ভাঙচুর করে আগুন দেয়। এসব সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগ, শিক্ষার্থী, অভিভাক, সাংবাদিক ও পুলিশসহ অন্তত দেড়শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। কুড়িগ্রাম : ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা জমায়েত হন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার চত্বরে। পুলিশ ও বিজিবি মাঝে অবস্থান নিয়ে । এক পর্যায়ে আন্দোলনকারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের সঙ্গে ধাওয়া-পালটাধাওয়া, ইটপাটকেল ছোড়া শুরু হয়। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দফায় দফায় চলে এ সংঘর্ষ। ত্রিমুখী সংঘর্ষে শতাধিক আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা কুড়িগ্রামে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকুর মোটরসাইকেলসহ ৫টি বাইক আগুনে পুড়িয়ে দেন। এছাড়া ফুলবাড়ী উপজেলায় বিক্ষোভকারীরা উপজেলা পরিষদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভাঙচুর করেন। এ সময় তারা ৪টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন। পরে তারা ফুলবাড়ী থানা ঘেরাও করেন। শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) : শাহজাদপুর আওয়ামী লীগ অফিস, এমপি চয়ন ইসলামের বাসভবন, শাহজাদপুর পৌরসভা কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। এতে পৌরসভার অধিকাংশ কক্ষ, কম্পিউটার, ৬টি গাড়ি ও মূল্যবান নথিপত্রসহ আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। এ বিষয়ে আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ আল সাফায়েত আদিব জানান, পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে আমিসহ ৮-৯ জন রাবার বুলেট বিদ্ধ হই। ফলে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের ধাওয়া দিলে পুলিশ ও ছাত্র লীগ পিছু হটে। এরপর শহরে এক বিশাল মিছিল করা হয়। দিনাজপুর : সুপ্রিমকোর্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও তার সহোদর জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের বাসভবন ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ধাওয়া-পালটাধাওয়ার এক পর্যায়ে পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ অসংখ্য টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, শটগানের গুলিবর্ষণ করে। আহত হয়েছে শতাধিক। দিনাজপুরের পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ জানান, অন্তত ৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ৬ জন সংবাদকর্মীও রয়েছেন।