অস্থির সচিবালয় কাজের চেয়ে আলোচনা বেশি


গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূরণ হয়েছে। সরকারের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল ছিল সচিবালয়। বিক্ষোভ, অবরোধ-অস্থিরতা, অনশন ছিল সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লেগেই ছিল সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে। এ সময় কাজের চেয়ে আলোচনা ছিল বেশি। প্রথমদিকে কিছুটা হিমশিম খেলেও পরে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় সরকার। তবে এখনো সুযোগ পেলেই সচিবালয়ের সামনে ছুটে আসেন বিক্ষুব্ধ জনতা। বিগত ১৫ বছরের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নানাভাবে বঞ্চিত এসব মানুষ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান। ৮ আগস্ট নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। তিন ধাপে নিয়োগের পর বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সংখ্যা ২৪ জন। সরকারের ১০০ দিনের অধিকাংশ সময় সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেটেছে অস্থিরতায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়েছে। অনেক সময় নিতে হয়েছে কঠিন সিদ্ধান্ত। নিরাপত্তার খাতিরে সচিবালয় এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। তাতেও কাজ হয়নি। চলতে থাকে সভা-সমাবেশ। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকেও বিশৃঙ্খলা করেন বিক্ষোভকারীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের নৌ-পরিবহণ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন শুক্রবার বলেন, ১৫ বছর থেকে সাধারণ ও বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে পূঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল। এই ক্ষোভ তারা ভয়ে প্রকাশ করতে পারেননি। এখন বাকস্বাধীনতা ও অধিকার ফিরে পাওয়ার পরিবেশ পেয়েছে। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রকাশ করছে। তিনি বলেন, অনেক মানুষের ক্ষোভ একত্রে হলে একটা অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হতেই পারে। তবে এরই মধ্যে সচিবালয়ের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। অনেক দাবি-দাওয়া পূরণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের ১০০ দিন-এটি খুব বেশি সময় নয়। এই অল্প সময়ে সরকারের অর্জন অনেক বেশি। প্রতিটি সেক্টরেই ভালো অর্জন আছে। আমরা সম্মিলিতভাবেই মানুষের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করছি। ১১ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কর্মদিবস থেকেই সচিবালয়ে সবার আলোচনার কেন্দ্রে ছিল বদলি, পদোন্নতি ও পদায়ন প্রসঙ্গ। এরপর প্রতিদিনই কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জনপ্রশাসন ভবনের বারান্দায় জটলা করে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। বিসিএস ক্যাডার থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী; পদ ও পদোন্নতির দাবিতে প্রকাশে-অপ্রকাশ্যে চলতে থাকে আন্দোলন, স্মারকলিপি প্রদান। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবনের নিচে, করিডরে মিছিল করতেও দেখা গেছে। দাবি দাওয়া সংবলিত এই ভিড় দিন দিন বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত তা সচিবালয় থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচ দফা দাবিতে সচিবালয়ের গেটে অবস্থান জবি শিক্ষার্থীদের : ১১ নভেম্বর সচিবালয়ের ফটকে ৫ দফা দাবিতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। সে সময় সচিবালয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা করা হয়। পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী সতর্ক অবস্থানের পাশাপাশি সচিবালয়ের সব ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সচিবালয়জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এ অবস্থান কর্মসূচিতে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছুটির পরেও অফিস থেকে বের হতে পারেননি। পরে রাতে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তাদের ৫ দফা দাবি মেনে নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। সচিবালয়ে ঢুকে পড়া অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আটক : ২৩ অক্টোবর এইচএসসির ফলাফল বাতিলের দাবি নিয়ে সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। তারা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ১ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে ৬ নম্বর ভবনের সামনে অবস্থান নেয় এবং বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। প্রতিবাদের একপর্যায়ে ছাত্ররা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়লে দায়িত্বরত পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর ছাত্ররা মারমুখী হলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ৫৪ জনকে আটক করে প্রিজন ভ্যানে থানায় নিয়ে যায়। পরে ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেদিন পুরো সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা গেছে। পরিক্ষার্থীরা সচিবালয়ে ঢুকে পড়ায় সচিবালয়ের সব প্রবেশদ্বার ও বের হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। এতে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রাত ৭টার দিকে গেট খুলে দেওয়া হয়। এর আগে ২০ আগস্ট এইচএসসি পরীক্ষা না দেওয়ার দাবিতে সচিবালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শত শত পরীক্ষার্থী। দাবি না মানা পর্যন্ত সচিবালয়ের ভেতরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে তারা। এদিন দুপুরে হঠাৎ মিছিল নিয়ে জিরো পয়েন্ট থেকে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। সচিবালয়ের নতুন করে আর পরীক্ষা না নিয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে এইচএসসির ফল প্রকাশের দাবি জানায় তারা। শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তাদের অটোপাশের দাবি মেনে নিলে পরীক্ষার্থীরা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে। ডিসি নিয়োগ নিয়ে হট্টগোল-হাতাহাতি : ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর ডিসি নিয়োগকে কেন্দ্র করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় তলায় যুগ্ম সচিবের (মাঠ প্রশাসন) রুমে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকতা লাঞ্ছিত হন। বিষয়টি নিয়ে ঘটনায় ১৭ উপসচিবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। তাদের মধ্যে আটজনকে গুরুদণ্ড, চারজনকে লঘুদণ্ড এবং পাঁচজনকে তিরস্কারের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ, তদন্ত কমিটি : মাত্র ৩৯ দিনের মাথায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল ডিসি নিয়োগে ঘুস কেলেঙ্কারির একটি অভিযোগ। জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি দৈনিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুস লেনদেন নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ডিসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার বার্তা সংবলিত কিছু হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন ও তিন কোটি টাকার একটি চেকের কপি ফাঁস হয়। সারা দেশে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। অভিযোগ তদন্তে তাৎক্ষণিকভাবে তিন উপদেষ্টার সমন্বয়ে গঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। মাসব্যাপী আলোচনায় থাকা অভিযোগটির পরিসমাপ্তি ঘটে ৩০ অক্টোবর। তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ডিসি নিয়োগে ঘুসের অভিযোগের সত্যতা পায়নি উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। ভেতরে পদোন্নতিবঞ্চিত, বাইরে চাকরিচ্যুতদের বিক্ষোভ : শপথ নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কার্যদিবসেই (১১ আগস্ট) সচিবালয়ের বাইরে রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চাকরিচ্যুত পুলিশের কনস্টেবল ও পরিদর্শকরা। একই দিন সরকারি কর্মকমিশনের বিসিএস ২৮তম ব্যাচ থেকে ৪২তম ব্যাচে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পরও নিয়োগবঞ্চিতরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জড়ো হন। অপরদিকে সরকারের প্রথম দিন থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে। এদিন সকালের দিকে সচিবালয়ের সামনের রাস্তায় একদল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগের নিয়োগকৃত সচিবদের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেন। দিনটিতে সচিবালয়ে কোনো কর্মচঞ্চলতা ছিল না। ডেস্ক ফেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছিলেন। অফিস ছুটির আগেই ভয় ও আতঙ্কে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সচিবালয় থেকে দ্রুত বাসায় ফিরতে দেখা গেছে। আন্দোলনের নামে অরাজকতা, ৪ শতাধিক আনসার আটক : টানা ৩ দিন (২৩ থেকে ২৬ আগস্ট) প্রেস ক্লাব থেকে সচিবালয় পর্যন্ত রাস্তা, সচিবালয়ের সব গেট অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনরত আনসার সদস্যরা। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে তারা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আনসার সদস্যদের অবস্থানের কারণে শেষের ২ দিন সচিবালয়ে প্রবেশ ও বের হওয়া ছিল সীমিত। সকালের দিকে স্বল্প পরিসরে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন কাজে আসা লোকজন বের হতে না পেরে সচিবালয়ের ভেতরের গেটগুলোর সামনে অবস্থান করেন। এ সময় দাবি না মানা পর্যন্ত সচিবালয়ের ভেতর থেকে কাউকে বাইরে বের হতে দেওয়া হবে না বলে আন্দোলনরত আনসার সদস্যরা হুঁশিয়ারি দেন। ২৬ আগস্ট বিকাল থেকে মারমুখী অবস্থান নেন আনসার সদস্যরা। আন্দোলনের নামে তারা সচিবালয়ে ঢুকে পড়েন। সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। রাত ২টা পর্যন্ত এ সংঘর্ষ চলে। আনসারদের আঘাতে গুরুতর আহত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় সংঘর্ষে লিপ্ত প্রায় চার শতাধিক আনসার সদস্যকে আটক করা হয়। এই ৩ দিন সচিবালয়ের সব কার্যক্রম প্রায় বন্ধ ছিল। সচিবালয়ে গেটে চাকরিচ্যুত বিডিআরের (৭৬ ব্যাচের) বিক্ষোভ : ১৮ আগস্ট সচিবালয়ের বাইরে রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চাকরিচ্যুত বিডিআরের (৭৬ ব্যাচের) ৫১৯ সদস্য। যারা তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহের সময় ট্রেনিং সেন্টারে ছিলেন। কিন্তু বিদ্রোহের অজুহাতে তাদের পর্যায়ক্রমে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে অভিযোগ করেন। একই দিন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা তাদের চলমান বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন। এদিন তারা কঠোর ও লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সচিবালয়ের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো হয়। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের বাইরেও প্রায় শতাধিক সংগঠন, বঞ্চিত মানুষ বিভিন্ন ব্যানারে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করেছেন। প্রতিটি আন্দোলনে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হয়েছে সচিবালয়ে দায়িত্বরত সেনা ও পুলিশ বাহিনীকে। উৎকণ্ঠায় অফিস করতে হয়েছে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তবে সবকিছু ঠিকভাবে মোকাবিলা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখার কোনো ত্রুটি রাখেনি অন্তর্বর্তী সরকার।