আমদানি নিষিদ্ধ ঘনচিনি শনাক্তের পরও খালাস


চট্টগ্রাম কাস্টমসে তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে। আমদানি পণ্যের বিবরণে তুচ্ছ ভুল বা ওজনে সামান্য হেরফেরের কারণে ক্ষুদ্র আমদানিকারক ও উৎপাদকদের ২০০ শতাংশ জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। অথচ শনাক্তের পরও আমদানি নিষিদ্ধ ১৪ হাজার কেজি ঘনচিনি (সোডিয়াম সাইক্লোমেট) খালাসের অনুমতি দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। এ পণ্য খালাসে জড়িতদের শনাক্তে গঠিত তদন্ত কমিটি কাস্টমস কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা পায়নি! পুরো ঘটনাকে অ্যাসাইকুডা সিস্টেমের দুর্বলতা এবং মানুষের ‘মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতা’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অনিয়মের সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তাকে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২০২২ সালে ঢাকার মিটফোর্ডের একটি বাণিজ্যিক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চীন থেকে ২০ হাজার ১৬০ কেজি ক্যালসিয়াম কার্বোনেট পাউডার (চুনাপাথর) আমদানি করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমসের এআইআর (গোয়েন্দা) শাখা পণ্যের রাসায়নিক পরীক্ষা করে দেখতে পায়, চালানে ১৪ হাজার কেজি ঘনচিনি এবং ৬ হাজার কেজি ক্যালসিয়াম কার্বোনেট পাউডার রয়েছে। এ ঘটনায় এআইআর শাখা থেকে আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট ও জেটি সরকারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সেই পণ্য পরে ছাড় করা হয়। ঘনচিনি মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমদানি নীতিতে নিষিদ্ধ। ২০০৬ সালে ঘনচিনির ব্যবহার ও আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। ঘনচিনি চিনির চেয়ে ৩০ থেকে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি; দামও কম, স্বাদ প্রায় চিনির মতোই। ঘনচিনির ব্যবহার ক্যানসার ঝুঁকি বাড়ায়। মানব হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। চিকিৎসাবিদ্যার ভাষায় একে মাইয়োকার্ডিয়াল ক্যালাসিফিকেশন বলা হয়। এটি শুধু হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয়; বরং মূত্রথলিসহ দেহের অন্যান্য পেশিতে এ ঘটনা ঘটে। সেক্স ক্রোমোজমের ক্ষতি হতে পারে। এ কারণে শেষ পর্যন্ত অস্বাভাবিক সন্তানের জন্ম হতে পারে। ঘনচিনির ব্যবহারে পুরুষের অণ্ডকোষের ক্ষতি হয়, টেস্টস্টেরন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। তাতে পুরুষত্বের হানি ঘটতে পারে। যৌন আকাঙ্ক্ষা এবং পুরুষের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে। তার ফলে সন্তান উৎপাদনে অক্ষমতা সৃষ্টি হতে পারে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে ১২টি প্যাকেটজাত ও ৪টি খোলা চিনির নমুনা সিঙ্গাপুরের প্যাসিফিক ল্যাবে পরীক্ষা করিয়ে তাতে সোডিয়াম সাইক্লামেট বা ঘনচিনির অস্তিত্ব পাওয়ার দাবি করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পণ্য চালান বন্দরে পৌঁছানোর দীর্ঘদিন পার হওয়ার পরও আমদানিকারক বিল অব এন্ট্রি (বি/ই) জমা না দেওয়ায় সন্দেহবশত এআইআর চালানটি লক করে। কায়িক পরীক্ষার মাধ্যমে নমুনা উত্তোলন করে চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হলে ঘনচিনির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ কারণে এআইআর বিল অব ল্যাডিং (বি/এল) লক করে এবং ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর টার্মিনাল ম্যানেজারকে কনটেইনারটিকে বিশেষ নজরদারি ও নিরাপত্তা হেফাজতে রাখতে চিঠি দেওয়া হয়। পরে ২৭ নভেম্বর কমিশনার ফাইলে মামলার সিদ্ধান্ত দেন। যেভাবে পণ্য খালাস নেওয়া হয় : ফৌজদারি মামলার সুপারিশের প্রায় ৩ মাস পর কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় ও পরামর্শে আমদানিকারকের সিএন্ডএফ এজেন্ট কৌশলে পণ্য খালাস নিতে এআইআর শাখায় ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি বি/এল আনলক করার আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এআইআর শাখা নতুন আরেকটি ফাইল খুলে বি/এল আনলকের পর নিয়ম অনুযায়ী বি/ই নোটিং করে এবং পরে সেই বি/ই লক করা হয়। ২১ জানুয়ারি কায়িক পরীক্ষার জন্য নমুনা উত্তোলন করা হয়। স্যাম্পল চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হলে রাসায়নিক পরীক্ষায় আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য পাওয়া যায়, অর্থাৎ ক্যালসিয়াম কার্বোনেট পাউডার পাওয়া যায়। এমনকি পরে শুল্ক গোয়েন্দার কায়িক পরীক্ষায়ও ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য পাওয়া যায়। কায়িক পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী ১৬ ফেব্রুয়ারিতে পণ্য খালাস দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পণ্য খালাসে ৪টি নথি খোলা হয়। এআইআর শাখার একটি নথি খোলা হয় বি/এল নম্বর দিয়ে। ঘনচিনির অস্তিত্ব পাওয়ার পর বি/এল লক করে সেই নথি এআইআর শাখা থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শুল্কায়ন শাখায় পাঠানো হয়। প্রায় এক মাস পর আরেকটি নথি খোলা হয়, আমদানিকারকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বি/এল আনলকের জন্য। এ নথির মাধ্যমে বি/এল আনলকের পর বি/ই নোটিং করে আবারও লক করা হয়। পরে শুল্কায়ন শাখার কায়িক পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে মালামাল খালাসের অনুমতি দেওয়া হয়। যে রিপোর্টে আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য পাওয়ার কথা নথিতে উল্লেখ রয়েছে। পণ্য খালাস নেওয়ার পর ২০২৩ সালের ৩১ মে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে এআইআর শাখা তৎকালীন উপকমিশনার সাইফুল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রাথমিক তদন্তে সিএন্ডএফ এজেন্ট লাইসেন্স বাতিল, আমদানিকারককে নজরদারিতে রাখা এবং এআইআর শাখার তৎকালীন শাখা সহকারীকে বরখাস্তের সুপারিশ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে শাখা সহকারীকে প্রাথমিকভাবে বরখাস্ত করা হলেও পরে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। পরে ১৩ জুলাই উপকমিশনার এইচএম কবিরকে আহ্বায়ক করে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিল অব এন্ট্রির (বি/ই) মতো বিল অব ল্যাডিং (বি/এল)-এর কনটেইনার কায়িক পরীক্ষার পর অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে ইনপুট দেওয়ার মতো ইন্সপেকশন অ্যাক্টের ব্যবস্থা নেই। ফলে বি/এল লকের পর কায়িক পরীক্ষার বিষয়টি অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে পাওয়া যায়নি। এটা অ্যাসাইকুডা সিস্টেমের বড় দুর্বলতা। এ দুর্বলতার সুযোগে ঝুঁকি নিয়ে সিএন্ডএফ এজেন্ট বি/এল আনলকের জন্য আবেদন করেন এবং পরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শুল্কায়ন সম্পন্ন করে পণ্য খালাস নেয়। এতে আরও বলা হয়, প্রতি মাসে এআইআর শাখায় ১০০টি নথি এবং শুল্কায়ন শাখায় এক হাজার নথি খোলা হয়। কোন নথিতে কী নির্দেশনা রয়েছে, তা মনে রাখা মনুষ্য ব্রেনের পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া ৪টি নথিতে কমন কোনো কর্মকর্তার সই পাওয়া যায়নি। তাই আলোচ্য জালিয়াতির সঙ্গে কাস্টমসের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও তদন্ত প্রতিবেদনে দোষ চাপানো হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের ওপর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দর কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা কনটেইনার এআইআর শাখার লিখিত নির্দেশনা ছাড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কিপডাউন (নামানো) করেছে এবং কিপডাউনের পর এআইআর শাখার কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা হেফাজতের বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার ফাইজুর রহমান বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির অধিক্ষেত্রাধীন ভ্যাট কমিশনারেটে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির গোডাউন পরিদর্শন করে তারা কী ধরনের পণ্য আদমানি ও বিক্রি করে তা জানাতে বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।