মানুষ আজ নানা সমস্যা আর অশান্তিতে নিপতিত। আজকের বিশ্ব যে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছে তা বহুমাত্রিক। এর ধরন-ধারণ যেমন বিচিত্র তেমনই এর অনেক জটিল দিকও রয়েছে। বিভিন্ন আঙ্গিকে আর বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এসব সমস্যা নিরসনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পন্থাগুলোর একটি হতে পারে ধর্মের ভিত্তিতে। প্রকৃতপক্ষে এ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য অবশ্যই এর ওপর প্রচুর অধ্যয়ন করা আবশ্যক, আর এতে গবেষণায় প্রাপ্ত ফল সমস্যাগুলো সমাধান করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এটি সুখকর ও সন্তুষ্টিজনক এক বিষয় হবে, যদি আমরা সবাই একসঙ্গে একত্রিত ও একমত হয়ে এ সমস্যাগুলো নিরসনে আমাদের চিন্তাভাবনাকে পরস্পরের সঙ্গে শেয়ার করে, আমাদের নিজ নিজ ধর্মের ভিত্তিতে এ সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজি, তবে আশা করা যায় তা খুঁজে পাওয়াটা খুব কঠিন হবে না।
ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম সবার কাছেই নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ ঐশী বাণীরূপে স্বীকৃত ও সুবিদিত, তাই মানুষের কার্যকলাপের বিভিন্ন দিকগুলো ঐশী মর্যাদার উচ্চমান অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হলে বিশ্ব বহুবিধ সমস্যার কবল থেকে মুক্তি পেতে পারে। ধর্মভিত্তিক জাতি-গোষ্ঠী বিবেচনায় সমকালীন বিশ্বের প্রায় সবাই অবশ্যই এর কোনো না কোনো একটির আওতাভুক্ত। এসব সমস্যার প্রতি যথাযথ দৃষ্টি দিয়ে মূল্যায়ন করা হলে, আর একে অপরের ধর্ম-বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে সহমর্মিতার নীতি ও শিক্ষার আলোকে উদ্দীপ্ত আদর্শের দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে বিশ্ব-নেতারা সহসাই তাবৎ সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাবেন, নিশ্চিতভাবেই এটা বলা যায়।
বিশ্বাসগত দিক থেকে যে নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে ইসলাম পরিপূর্ণতার দাবি করে, তা হলো জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সুন্দর সাবলীল জীবনপথের সব মৌলিক বিধান সংবলিত মহান নির্দেশিকা আল কুরআন। কারণ, এতে বর্ণিত শিক্ষামালা অন্য কোনো সোর্স থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা নয়, বরং বিশ্বজগতের স্রষ্টা স্বয়ং নিজ করুণায় মানুষের সার্বিক মঙ্গলের জন্য স্বীয়-বাণী পূর্ণাকারে ফেরেশতা জিবরাইলের মুখে মহানবি (সা.)-এর কাছে পাঠিয়েছেন, যদিও ইতঃপূর্বে তিনি খণ্ডিতাকারে বা আংশিকভাবে বিভিন্ন নবীদের অনুরূপ বাণী পাঠিয়েছিলেন।
অধুনা উদ্ভূত সমস্যাগুলোর গভীরে অন্তর্নিহিত বিষয়াদি সম্পর্কে অনেকেই এ সত্যটি বুঝে উঠতে পারে না যে, আমরা যে জগতে বাস করছি তা দ্রুততার সঙ্গে উন্নততর এক মাত্রায় একাকার হয়ে যাচ্ছে। মানবজাতি এখন, একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সঙ্গে বসবাস করা সময়ের দাবি। অন্য কথায়, তাদের মাঝে সত্যিকারেই ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা সমুন্নত রাখা এখন বাস্তবে প্রকাশমান এক সত্য। এজন্য অবশ্যম্ভাবীরূপে অনেক কিছুরই সমন্বয় সাধন করা শিখতে হবে। এহেন অবস্থায় চোখ-কান বুজে থাকা আত্মহত্যারই নামান্তর। অতএব, এ যুগে কূপমণ্ডুকতার কোনো ঠাঁই থাকতে পারে না।
তাই আজ, মানুষের চাহিদা পূরণ করতে হলে চাই এমন একটি বিশ্বাসপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, যা রাষ্ট্রীয় উপজাতীয়, জাতীয়, জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক সীমা অতিক্রম করে সর্বজনীনতার স্তরে মানুষের অধিকার ও বিকাশমান ক্রমোন্নতিধারা নিশ্চিত করবে। পবিত্র কুরআন শরিফের সূচনায়ই রয়েছে, সব প্রশংসা আল্লাহ, সমগ্র বিশ্বজগতের প্রভু প্রতিপালকের জন্য (সূরা ফাতিহা)। এ আয়াত সামগ্রিকভাবে এক মানবতা আর একই মহাবিশ্বের ধারণা উপস্থাপন করে গোটা মানবজাতিকে এক সূত্রে গেথে দিয়েছে। ইসলামের বার্তা মানবজাতির কোনো অংশের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সমগ্র মানবজাতিকে এবং সমগ্র বিশ্ব জগৎকে ধারণ করে রয়েছে। অনুরূপভাবে, মহান গ্রন্থ আল কুরআনে আরও রয়েছে-তুমি বল, ‘হে মানুষ! নিশ্চয় আমি তোমাদের সবার জন্য আকাশগুলোর ও পৃথিবীর রাজত্বের অধিকারী আল্লাহর (প্রেরীত) রাসূল। তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নাই। তিনি জীবিত করেন এবং মৃত্যুও দেন। অতএব, তোমরা ইমান আন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল এ উম্মি নবির প্রতি, যে আল্লাহতে ও তাঁর বাণীগুলোয় ইমান রাখে এবং তোমরা তাঁকে অনুসরণ কর যাতে তোমরা হেদায়াত লাভ কর।’ (সূরা আল আরাফ, ১৯ রুকু)।
ইসলাম মানুষের মাঝে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে। পবিত্র কুরআনে ঐক্যবদ্ধ থাকার শিক্ষাদান করে বলা হয়েছে-তোমরা সবাই ‘আল্লাহর রজ্জু’ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ো না। আর আল্লাহর সেই অনুগ্রহ স্মরণ কর যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তখন তিনি তোমাদের হৃদয় প্রীতির বাঁধনে বেঁধে দিলেন এবং তোমরা তারই অনুগ্রহে ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা এক অগ্নিকুণ্ডের কিনারায় ছিলে, তিনি তা থেকে রক্ষা করলেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা হেদায়াত লাভ কর। (সূরা আলে ইমরান, ১১ রুকু)।
আজ মানুষ আবারও ধ্বংসের অতল এক গহ্বরের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ যুগের জন্যও তিনি পথনির্দেশ দান করেছেন, আর তার সেই আদেশের ব্যাখ্যা দিয়ে জানিয়েও দিয়েছেন, মানবজাতি কী করে সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে? ইসলাম মানুষের গায়ের রং, জাতি, ভাষা ইত্যাদি বৈচিত্র্যময়তাকে নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উপযোগী ও উপকারী বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-আর তাঁর নিদর্শনাবলির মাঝে রয়েছে আকাশগুলো ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বিভিন্নতা। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে। (সূরা আর রুম)। কিন্তু এ ঘোষণা একচেটিয়াভাবে কাউকেই বিশেষ কোনো অগ্রাধিকার প্রদান করে না, কেননা কারও সত্যিকারের সম্মান নির্ভর করে শুধু তার নিজ জীবনে প্রতিপালিত পবিত্রতা ও ন্যায়পরায়ণতার ওপর। বর্ণ, জাতি বা গোষ্ঠী সম্পর্কিত বা পরিবার, পদ, সম্পদ থেকে প্রাপ্ত পার্থক্যসূচক কোনো বিশেষাধিকার যদি দৃষ্টিগোচর হয়ও, তবে এ ঘোষণা দ্বারা তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ ঘোষিত এ নীতিমালা দ্বারা ইসলাম সমগ্র মানবজাতিতে এক মহান ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরুক রেখে আমাদের সবার মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে এবং সৎকর্ম সাধনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমাদের পরস্পরের সঙ্গে সদ্ব্যবহার ও সদাচরণ করার শিক্ষা দেয়।
সুতরাং ইসলাম মৌলিক একত্বের ওপর ভিত্তি করে নিজেকে উপস্থাপন করায় স্রষ্টার একত্ব, মহাবিশ্বের একতা, মানুষের ঐক্য এবং জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে এক সামগ্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। জুতসই ও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হলো ইসলামের উদ্দেশ্য, যাতে মানব-কার্যকলাপের সব দিকের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে এমন একটি ভারসাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, স্থায়িত্বের মানে যা হবে কালোত্তীর্ণ আর উন্নতির দুয়ার থাকবে অবারিত। আল্লাহপাক সবাইকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
masumon83@yahoo.com
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।