উড়োজাহাজ উদ্ধারে চালু হচ্ছে আধুনিক ব্যবস্থা


রানওয়ে থেকে দুর্ঘটনাকবলিত বিমান দ্রুত উদ্ধার ও অপসারণের জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চালু হচ্ছে অত্যাধুনিক ‘ডিসেবল এয়ারক্রাফট রিকভারি সিস্টেম’ (ডার্স)। এর মাধ্যমে সর্বাধিক ৪৪০ টন ওজনের বিশ্বের সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৪৭, বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর এবং এয়ারবাস ৩৫০ কার্গো বিমানগুলো রানওয়ে থেকে দ্রুত সরানো সম্ভব। এতে দুর্ঘটনাকবলিত বিমানগুলোর বডি ও ল্যান্ডিং গিয়ারের কোনো ধরনের ক্ষতি হবে না। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের কোনো বিমানবন্দরে এ সিস্টেম নেই। বর্তমানে কোনো বিমান দুর্ঘটনার শিকার হলে তা উদ্ধার করতে এয়ারক্রাফটগুলোর নানা ধরনের ক্ষতি হয়। বিমানের গায়ে আঘাত লাগে। নষ্ট হয়ে যায় বিমানের চাকা, ল্যান্ডিং গিয়ারসহ মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এতে একদিকে এয়ারক্রাফট মেরামতে ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়। অপরদিকে উদ্ধারকাজেও সময় বেশি লাগে। দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্স মালিকরা বিমানবন্দরে এ প্রযুক্তিটি স্থাপন ও চালুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছিলেন। খোদ ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষেরও (আইকাও) চাপ ছিল শাহজালালে ডার্স প্রযুক্তি স্থাপনের। অবশেষে বহুলপ্রতীক্ষিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেবিচক। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ কোটি টাকা। বিশ্বখ্যাত বিমান প্রস্তুতকারী কোম্পানি বোয়িং এবং এয়ারবাসের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছ থেকেই মূলত এ প্রযুক্তিটি ক্রয় করা হচ্ছে। কারণ, বিশ্বের প্রায় সব দেশে বর্তমানে এয়ারবাস ও বোয়িং কোম্পানির তৈরি বিমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ারক্রাফট রিকভারি সিস্টেম নেই। এতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। খোদ ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট পরিচালনার জন্যও বিমানবন্দরে এ প্রযুক্তি স্থাপনের বাধ্যবাধকতার শর্ত আছে বলে জানা গেছে। জরুরি অবস্থায় বিমান পুনরুদ্ধার করতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। এতে বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে একটি আধুনিক এয়ারক্রাফট রিকভারি সিস্টেম স্থাপন করা জরুরি। জানা যায়, প্রকল্পটি স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করেছে বেবিচকের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড স্টোর (সেমসু) বিভাগ। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যাত্রী ও উড়োজাহাজের নিরাপত্তা এবং অপারেশনাল স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর জন্য এটি একটি বিশেষ পদক্ষেপ। পাশাপাশি দুর্ঘটনাকবলিত ও আটকে পড়া বিমানগুলো দ্রুত উদ্ধারের মাধ্যমে রানওয়ে সচল করতে প্রযুক্তিটি কাজ করবে। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, কর্তৃপক্ষ যে প্রযুক্তিটি নিচ্ছে, সেটি ব্যবহারে কম লোকবল প্রয়োজন হবে। এর হাইপ্রেশার লিফটিং ব্যাগগুলো অল্প সময়ে দুর্ঘটনাকবলিত বিমানকে রানওয়ে থেকে আলাদা করবে। এতে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া একটি ডিসেবল বিমান রানওয়ে থেকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। এ প্রক্রিয়ায় প্রচলিত লো-প্রেশার কাউন্টার পার্টসের তুলনায় আরও দক্ষভাবে বিমানগুলোর পুনরুদ্ধার সম্ভব। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, সিস্টেমটি ক্রয়ের জন্য দেড় বছর ধরে সিরিজ বৈঠক করেছেন বেবিচক ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। ডিসেবল এয়ারক্রাফট রিকভারি সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে বিশ্বের এমন একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। কোম্পানিগুলো তাদের সিস্টেম ও কার্যক্রম ডিজিটালি উপস্থাপন করে কর্তৃপক্ষকে দেখিয়েছে। কয়েক বছরের বিভিন্ন দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে বেবিচক বলছে, এ সময়ে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ৩টি, চট্টগ্রামে ১টি বড় দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় বেবিচক তাদের নিজস্ব যন্ত্রপাতির পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য সংস্থার ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সাহায্যে দুর্ঘটনাকবলিত এয়ারক্রাফট উদ্ধার করেছে। এছাড়া থার্ড টার্মিনাল অপারেশনাল হলে দেশে বিমান উড্ডয়ন-অবতরণের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। তখন দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও বৃদ্ধির শঙ্কা আছে। কাজেই নতুন ব্যবস্থাটি দ্রুত চালু করা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ডার্স ক্রয়ের বিষয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে কোড সি (ড্যাস-এইট, এটিআর-৭২, বি-৭৩৭, এ-৩২০) ডি (এ-৩৩০, এ/৩৫০) এবং কোড ই (বি-৭৮৭, বি-৭৭৭, বি ৭৪৭) টাইপ এয়ারক্রাফটের মুভমেন্ট বেশি হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোয় চলাচলকারী কোড সি, ডি, এবং ই টাইপ এয়ারক্রাফট মুভমেন্টের তুলনামূলক হিসাবের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত ডার্স ক্রয়ের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কোড সি টাইপ এয়ারক্রাফটের মুভমেন্ট ৬৩২৫টি। কোড-ডি টাইপ এয়ারক্রাফট মুভমেন্ট ৯০৪টি, এবং কোড-ই টাইপ এয়ারক্রাফট মুভমেন্ট ১৬০৩টি। সাধারণত কোড-সি, ডি এবং ই টাইপ এয়ারক্রাফটের মধ্যে বোয়িং ৭৮৭, বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর এবং বোয়িং ৭৪৭ এয়ারক্রাফট সব চেয়ে বড় আকারের বিমান। যার মুভমেন্ট শাহজালালে এখন সবচেয়ে বেশি। সেহেতু কোড-ই টাইপ এয়ারক্রাফট আদর্শ ধরে অচল বিমান উদ্ধারযান (ডার্স) ক্রয় করা যেতে পারে। কোড-সি/ডি টাইপ এয়ারক্রাফটও দুর্ঘটনার শিকার হলেও এটি দিয়ে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদ উল আলম বলেন, বর্তমানে শাহজালালে একটি মাত্র রানওয়ে আছে। ফলে যে কোনো বিমান দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো বিমানবন্দরের অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এতে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়ে। বর্তমানে বেবিচকে অচল বিমান উদ্ধারকাজে ব্যবহার উপযোগী কোনো নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতি নেই। কাজেই উদ্ধারকাজের জন্য বেবিচকের সক্ষমতারও প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন নাসের উদ্দিন বলেন, বিমান পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, যা জরুরি অবস্থায় বা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিমানের নিরাপদ অবতরণ এবং পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। ডিআরএস বিমানের চাকার ক্ষতি বা হাইড্রোলিক সমস্যা সমাধান করতে পারে এবং রানওয়ে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে বিমানের নিরাপত্তা এবং বিমানবন্দরের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায়।