ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা চায় আইএমএফ


আশঙ্কাজনক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানান। পদক্ষেপের অংশ হিসাবে খেলাপির ওপর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে ইতোমধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের কথা জানানো হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে সব খেলাপির জন্য নতুন ঋণ অনুমোদন বন্ধ ও বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও জানিয়েছেন। পাশাপাশি খেলাপিদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকে (আরজেএসসি) নতুন করে তালিকাভুক্তির সুযোগ বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে। বুধবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এসব বিষয় ওঠে আসে। সভায় সংশ্লিষ্ট ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন রাহুল আনন্দ। সভায় নীতি সুদ ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এর আগে সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। আইএমএফ বেশকিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ফেব্রুয়ারিতে পায় বাংলাদেশ। দেশে এখন ডলার সংকট চলছে। এই সময়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরে এই কিস্তি পাওয়ার কথা। তবে তা নির্ভর করছে ঋণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শর্ত পরিপালনের ওপর। তাই সরকারি বিভাগগুলো শর্ত পূরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। অংশীজনদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করবে আইএমএফ। আর্থিক খাতের স্থায়িত্ব, ব্যাংক খাতের সংস্কার, তারল্য ব্যবস্থাপনা, ডলারের বাজারভিত্তিক লেনদেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন, ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি, সুদের হার ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। এরই অংশ হিসাবে প্রথম দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় বসে সংস্থাটির বিশেষ প্রতিনিধিদল। বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইএমএফের ঋণের যেসব শর্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পূরণ করার কথা, তার মধ্যে বেশিরভাগ পূরণ হয়েছে। তবে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখার শর্ত দেওয়া হয়েছিল, সেই পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের সময় কিছু শর্ত দিয়েছিল। এর মধ্যে বেশকিছু শর্ত পূরণ করা হয়েছে। দু-এক জায়গায় ব্যর্থতা আছে। রিজার্ভ কিছু কম আছে। রাজস্ব আহরণ কম হয়েছে। তবে অনেক কিছু বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করেছে। বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া মুদ্রার বাজার-নির্ধারিত বিনিময় হার প্রবর্তন করা হয়েছে। সুদহারের নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে। তাদের দেওয়া যেসব শর্ত অর্জন হয়েছে তা জানিয়েছি আর যেগুলো অর্জন হয়নি সেগুলো কেন হয়নি তাও জানানো হয়েছে। শর্ত পূরণ ও ব্যর্থতা নিয়ে আইএমএফের পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মুখপাত্র বলেন, শুধু তো বৈঠক শুরু হয়েছে। তারা (আইএমএফ) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে বসে আলোচনা করবে। প্রথমে তথ্য নিচ্ছে তারপর আবার বৈঠক করবে। ১৯ অক্টোবর শেষ মিটিং, সেখানে তাদের মতামত জানাবে। আমরাও আমাদের বিষয়গুলো জানাব। আইএমএফের শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার রাখা, সেপ্টেম্বরে তা ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলারে রাখতে হবে। এখন রিজার্ভের তিন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভ। দুই ধরনের হিসাব (মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করলেও প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না। তবে প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য নিয়মিত আইএমএফকে জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য বলছে, জুনে দেশের মোট (গ্রস) রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ (ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) অনুযায়ী জুনে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার আর বিপিএম ৬ অনুযায়ী আছে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলার। এর বাইরেও প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি তথ্য আছে, যা প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী, এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ২০ বিলিয়ন ২ হাজার কোটি ডলারের মতো, যা আইএমএফকে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রকৃত এ রিজার্ভ দিয়ে এখন ৩ মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারবে বাংলাদেশ। অর্থ বিভাগের সঙ্গে আইএমএফের বৈঠক : বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অর্থ সচিবের সঙ্গে টানা সোয়া ঘণ্টা বৈঠক করেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এ সময় অর্থসচিব সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আইএমএফ মিশনকে অবহিত করে। বৈঠক শেষে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে আশাবাদী কিনা জানতে চাইলে অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আলোচনা শুরু হয়েছে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।