এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস: ড. আলী রীয়াজ


যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, এই নতুন সরকারের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছর এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নির্বাচনব্যবস্থা সবই সুপরিকল্পিতভাবে রাজনীতিকরণের শিকার হয়েছে। সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর স্বায়ত্তশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা জনগণের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। ড. আলী রীয়াজ বলেন, ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়। ছাত্র-জনতার অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। তথ্যমতে, এ অভ্যুত্থানে ৭৫০-এরও বেশি প্রাণহানি হয় এবং দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশাল পরিবর্তন সূচিত হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন এবং ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে। লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নীতিমালা জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং জ্বালানি খাতে স্বার্থবাদী একটি নেটওয়ার্ক গঠিত হয়, যারা নিজেদের স্বার্থে এ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ঋণখেলাপিদের বিচার থেকে রক্ষা করা হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বিপদাপন্ন করেছে। সরকারের সঙ্গে যুক্ত একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী জ্বালানি খাতের ভর্তুকি পকেটস্থ করেছে, যা দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। ড. আলী রীয়াজ বলেন, এসবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে বিশাল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সংবিধানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। গণজাগরণের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এ আশা ও প্রত্যাশা পূরণ করতে সরকারের প্রতি বিশাল দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘দেশবাসীকে অনুরোধ করব, একটা আলোচনা শুরু করতে, আমরা সর্বনিম্ন কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাব, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে। এ আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারি তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে।’ এ প্রেক্ষাপটে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিজিএস-এর পক্ষ থেকে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যার লক্ষ্য হলো টেকসই গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংলাপের আয়োজন করা। এ সংলাপগুলোর মাধ্যমে দেশব্যাপী নাগরিক সমাজ, সুশীলসমাজ এবং বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ সংগ্রহ করা হবে। এর ফলে ভবিষ্যতের জন্য একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রণয়ন করা সম্ভব হবে, যা গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে সহজতর করবে এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। ড. আলী রীয়াজ বলেন, শুধু অন্তর্বর্তী সরকার সব দায়িত্ব পালন করবে, এটা যেন না হয়। সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। সহযোগিতা করতে চাই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো মিস ইনফরমেশন, ডিস ইনফরমেশন দিয়েছে, সে প্রেক্ষাপটে সত্য তুলে ধরুন। আমাদের গণমাধ্যমকে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. আলী রীয়াজ বলেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রস্তাব দেখেছি, তারা প্রস্তাব দিয়েছে দলীয় প্রধান আর সরকারপ্রধান যেন এক না হন। আমি মনে করি, ক্ষমতা এককেন্দ্রিক যেন না হয়। এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, সংবিধানের পুনর্লিখন। এর বাইরে আপনি প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করতে পারবেন না। ফলে দুই মেয়াদ, তিন মেয়াদ এ প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে, সেটা সবাই আলোচনা করে করতে পারে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দুই মেয়াদ যথেষ্ট। যেমনটি অন্যত্রও হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়াদের সময়সীমাটা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বিশেষ ব্যবস্থায় এটা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।