কেন্দুয়ায় ইউএনও’র প্রচেষ্টায় অবসান হল ৩০ বছর ধরে চলে আসা বিরোধ


জমিজমা সংক্রান্ত ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইল বাড়ি ইউনিয়নের আমতলা গ্রামের প্রভাবশালী দুইপক্ষের লোকজনের মধ্যে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে চলে আসা বিরোধ অবশেষে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) ইমদাদুল হক তালুকদারের হস্তক্ষেপ ও প্রচেষ্টায় মীমাংসা হয়েছে। বুধবার (১৭ এপ্রিল) বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে দীর্ঘ এক সংহতি সভার মাধ্যমে এ বিরোধের অবসান ঘটে। বিরোধ মীমাংসা হওয়ায় খুবই আনন্দিত উভয়পক্ষসহ পুরো আমতলা গ্রামের বাসিন্দা ও এলাকার লোকজন। তারা ইউএনওর এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশ ও বিরোধে জড়ানো দুপক্ষের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আমতলা গ্রামের বাসিন্দা এডভোকেট রফিকুল ইসলাম গং একই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ওরফে নারু মিয়া গংদের মধ‌্যে এলাকায় আধিপত‌্য বিস্তার ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩০ বছর ধরে এ বিরোধ চলে আসছিল। আসছিল। এ নিয়ে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি মামলা চলছিল। শুধু তাই নয়, বিরোধকে কেন্দ্র করে নানা সময়ে দুটিপক্ষের মধ‌্যে অনেকবার ধারালো অস্ত্র নিয়ে মারামারি, গাছপালা ও বাড়িঘর ভাংচুর, পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে মাছ নিধন ও গরু-চুরিসহ নানা ধরণের ঘটনা ঘটে। এসব বিষয় নিয়ে আমতলা গ্রামটি অশান্ত ছিল। এদিকে সর্বশেষ গত রোববার (১৪ এপ্রিল) দিবাগত রাতে উভয়পক্ষ লোকজন বিপুল পরিমাণ ধারালো দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র যার যার বাড়িঘরে মজুদ করে এক ভয়ানক রক্তক্ষয়ী মারামারির প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাজিব হোসেন ও কেন্দুয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. এনামুল হক পিপিএম কে সাথে নিয়ে বিপুল পরিমাণ পুলিশ ফোর্সসহ মধ‌্যরাতে আমতলা গ্রামে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে উভয়পক্ষের লোকজনের বাড়িঘরে গিয়ে সকল অস্ত্র উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে ইউএনও স্থানীয় গণ‌্যমান‌্য ব‌্যক্তিদের সহায়তায় উভয়পক্ষকে নিয়ে বুধবার (১৭ এপ্রিল) বিকেলে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক সংহতি সভা আহবান করেন। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ সভা। সভায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাজিব হোসেন, কেনৃদুয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হোসাইন মোহম্মদ ফারাবী, ওসি মো. এনামুল হক পিপিএম, কেন্দুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট আব্দুল কাদির ভূইয়া, পৌর মেয়র মো. আসাদুল হক ভূইয়া, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. লুৎফুর রহমান আকন্দসহ স্থানীয় গণ‌্যমান‌্য ব‌্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। ইউএনও ইমদাদুল হক তালুকদারের সভাপতিত্বে ওই সংহতি সভায় প্রথমে উভয়পক্ষের বক্তব‌্য শোনা হয় এবং এর প্রেক্ষিতে সকলের সম্মতিতে ১০ সদস‌্যের একটি জুরি বোর্ড গঠন করা হয়। যেখানে ইউএনওসহ এসিল‌্যান্ড, সার্কেল এএসপি, ওসি, রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম‌্যানসহ অন‌্যান‌্য ব‌্যক্তিবর্গ সম্পৃক্ত ছিলেন। জুরি বোর্ড আলোচনা শেষে তিনটি সিদ্ধান্ত প্রদান করে। সিদ্ধান্তগুলো হল, প্রথমত, উভয় পক্ষের চলমান মামলাসমূহ দ্রুত ও সহজতর নিষ্পত্তির জন‌্য সার্কেল এএসপির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় যারা পক্ষগণের আপোষের মাধ‌্যমে চলমান পাল্টাপাল্টি মামলাসমূহের দ্রুত নিষ্পত্তিতে উদ‌্যোগ গ্রহণ করবেন। দ্বিতীয়ত, পক্ষগণের মধ‌্যে চলমান জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধসমূহ বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর নেতৃত্বে অপর একটি কমিটি গঠন করা হয় যার মাধ‌্যমে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধসমূহের নিষ্পত্তি করা হবে। তৃতীয়ত, ভবিষ‌্যতে পক্ষগণ যদি কোনো প্রকার মারামারির ঘটনা ঘটায় সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে তা দমন করা হবে। এ ঘোষণার সাথে সাথে উভয়পক্ষের লোকজন উল্লাসের সাথে এ সিদ্ধান্ত মেনে নেন এবং দুইপক্ষের নেতৃত্বদানকারী এডভোকেট রফিকুল ও আব্দুর রাজ্জাক ওরফে নারু মিয়া পরস্পর বুকে বুক মিলিয়ে ৩০ বছরের এ হিংসা-বিদ্বেষের অবসান ঘটান। এ সময় রফিক-নারুর চোখ আনন্দ ও অনুতাপে অশ্রুসজল হয়ে উঠে এবং তারা মহামিলনের এ মাহেন্দ্রক্ষণের আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে সময় উপস্থিত হাজারও গ্রামবাসীর মুখে আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। বিরোধে জড়ানো একপক্ষের নেতা এডভোকেট রফিকুল ইসলাম বলেন, বিরোধের জন্য আমরা উভয়পক্ষই নানাভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। মীমাংসা না হলে হয়তো আরো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারতো। যাই হোক আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হয়েছেন। অপরপক্ষের নেতা আব্দুর রাজ্জাক ওরফে নারু মিয়া বলেন, আমাদের দুপক্ষের মধ্যে বিরোধের কারণে পুরো গ্রামজুড়েই শান্তি ছিল না। কিছুদিন পরপরই মারামারি ও মামলাসহ কোনো না কোনো ঝামেলা লেগেই ছিল। অবশেষে বিরোধের মীমাংসা হওয়ায় গ্রামে এখন শান্তি ফিরেছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. লুৎফুর রহমান আকন্দ বলেন, আমতলা গ্রামের দুপক্ষের এ বিরোধ দীর্ঘদিনেও মীমাংসা করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু ইউএনও মহোদয়ে ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অবশেষে তার অবসান ঘটেছে। এ জন্য ইউএনও স্যার আমার ইউনিয়নবাসীর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কেন্দুয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. এনামুল হক পিপিএম বলেন, দুটি পক্ষের মধ্যে চলে আসা এ বিরোধ বর্তমানে চরমে পৌছেছিল। এ বিরোধের জেরে কখন কি হয়- সে জন্য এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতে হতো। বিরোধ মীমাংসা হওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত। মানুষ শান্তিতে ও নিরাপদে বসবাস করুক- এটাই আমাদের চাওয়া। এ বিষয়ে ইউএনও ইমদাদুল হক তালুকদার জানান, উভয়পক্ষের মধ‌্যে \'বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি\' পদ্ধতির মাধ‌্যমে প্রায় ৩০ বছরের এ বিরোধের পরিসমাপ্তি সত‌্যিই প্রশাসন, পুলিশ ও এলাকার জনগণের জন‌্য সুখের একটি বিষয়। আশা করি, আজকের এ সংহতি সভার মাধ‌্যমে আমতলা গ্রামের এ সংঘাত সম্প্রীতিতে রূপ নেবে।