খুলনায় প্রতিমন্ত্রী-হুইপ যে কারণে আ.লীগের মনোনয়ন পাননি


বিভাগীয় শহর খুলনার ছয়টি আসনের তিনটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন বর্তমান শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ও খুলনা-৩ আসনের পরপর তিনবারের সংসদ সদস্য বেগম মন্নুজান সুফিয়ানসহ এবং খুলনা-১ আসনের পরপরের দুইবারের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ পঞ্চানন বিশ্বাস। অপর আরেকজন প্রার্থী হলেন ঠিকাদারি কাজ নিয়ে আলোচিত খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু। অনুসন্ধানে জানা যায়, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, এলাকায় উন্নয়ন কাজ কম হওয়া, ঠিকাদারি কাজের বাণিজ্য, পারিবারতান্ত্রিকভাবে দাপটসহ নানান লাগামহীন অনিয়মের কারণেই এই তিন সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। এদিকে বেগম মন্নুজান সুফিয়ান মনোনয়ন না পাওয়ায় তার সমর্থকরা রোববার ও সোমবার বিকালে নগরীর নতুনরাস্তা, ফুলবাড়িগেট ও রেলগেট এলাকায় অগ্নিসংযোগ, অবরোধ এবং মানববন্ধন করেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচক্ষণতার সঙ্গেই দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে সবার কাজ করতে হবে। তবে যারাই এই মনোনয়নের বিরুদ্ধে রাস্তায় অবরোধ এবং অগ্নিসংযোগ করছেন তারা মূলত দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন। এটা মোটেই ভালো সংকেত নয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্তরা হলেন- খুলনা-১ (বটিয়াঘাটা-দাকোপ) আসনে সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মণ্ডল, খুলনা-২ (সদর-সোনাডাঙ্গা) আসনে বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্র ও বর্তমান সংসদ সদস্য সেখ সালাউদ্দিন জুয়েল, খুলনা-৩ (দৌলতপুর-খালিশপুর-খানজাহানআলী) আসনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, খুলনা-৪ (রূপসা-দিঘলিয়া-তেরখাদা) আসনে বিজেএমইর সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী, খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এবং খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে পাইকগাছা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. রশীদুজ্জামান মনোনয়ন পেয়েছেন। খুলনা তিনটি আসনের হেভিওয়েট প্রার্থীরা মনোনয়ন না পাওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীর মধ্যে খুলনা-৩ আসনে এসএম কামাল হোসেনের পক্ষে আওয়ামী লীগ অফিসে দোয়া, আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ যেমন হয়েছে তেমনিভাবে মনোনয়ন না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে অগ্নিসংযোগ, অবরোধের মতো ঘটনা ঘটেছে। খুলনা-৬ আসনে মো. রশীদুজ্জামানের মনোনয়ন নিয়ে অনেকেই অবাক হয়েছেন। কারণ এই আসনে দেড় ডজন প্রার্থী ছিলেন। যারা অনেকেই দীর্ঘদিন থেকেই মাঠে রয়েছেন। মো. রশীদুজ্জামান পাইকগাছা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আহবায়ক। তার ক্লিন ইমেজের কারণে প্রধানমন্ত্রী তাকে মনোনয়ন দিয়েছেন বলে এলাকাবাসীর প্রত্যাশা। খুলনা-১ আসনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের আপন ছোট ভাই এবং এপিএস মো. শাহাবুদ্দিন এবং ভাতিজি শামীমা সুলতানা হৃদয়কে নিয়ে একাধিকবার মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছেন। তার পরিবারের সদস্যদের অসহনীয় দাপটের প্রভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মুখ খুলতে সাহস পায়নি। তার নিকটস্থ একজন ইউপি সদস্যের দাপট, বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়েটে একক আধিপত্য, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের প্রভাব ছিল মানুষের মুখে মুখে। তিনি ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন, পরবর্তীতে ২০১৪ সালে তাকে প্রতিমন্ত্রিত্ব দেওয়া না হলেও ২০১৮ সালে ফের তাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘ তিনবার সংসদ সদস্য থাকার পর তার পারিবারের সদস্যসহ নির্দিষ্ট কয়েকজন নেতার আধিপত্য বেড়ে যায়। সম্প্রতি কুয়েট ও খুকৃবি ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে এই প্রতিমন্ত্রীর এক আত্মীয়ের প্রভাব ছিল বলে জানা যায়। খুলনা-১ আসনের পরপর দুইবারের সংসদ সদস্য এবং বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ পঞ্চানন বিশ্বাস দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার পেছনে তিনটি কারণ দাবি এলাকাবাসীর। এর মধ্যে রয়েছে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, উপকূল এলাকা হিসেবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলনামূলক কম হওয়া এবং বয়সের ভারে ন্যুব্জ। এছাড়া খুলনা-৬ আসনে ২০১৮ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য হয়েই আলোচিত হয়ে উঠেন আক্তারুজ্জামান বাবু। তিনি ক্ষমতায় আসার পরপরই স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার দূরত্ব শুরু হয়। সুন্দরবনে তার কর্মীদের দিয়ে আধিপত্য, কয়রা-পাইকগাছা এলাকায় তার প্রতিষ্ঠানের নামে ঠিকাদারি কাজ করা, অন্য ঠিকাদারদের নানানভাবে বাধা দেওয়া, বিতর্কিত কর্মী নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, উপকূলের নানান ঠিকাদারি কাজে অনিয়মসহ নানান অভিযোগ ছিল। এমনকি এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে সংসদ সদস্যকে কাদা মেরে এলাকা ছাড়া করলে তিনি ট্রলার নিয়ে পালিয়েছিলেন। এসব বিষয়ে খুলনা-১ আসনের সংসদ সদস্য পঞ্চানন বিশ্বাস জানান, দলের সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ করে আগামীতে একত্রে চলব। খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন। খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, আমি নৌকা প্রতীকের বাইরে কোনো নির্বাচন করব না।