গোপালগঞ্জের ৯ স্বজনকে চাকরি দেন সাবেক সচিব


ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ইপিআই সুপারভাইজার পদে চাকরি করছেন লাইজু খানম। চলতি বছরের ৫ মে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতনি কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। তবে সিটি করপোরেশনে করা চাকরির আবেদনে এই কোটাই উল্লেখ করেননি তিনি। শতচেষ্টায়ও যেখানে চাকরি নামের সোনার হরিণ ধরা দেয় না, সেখানে কোটা উল্লেখ না করেও কোটায় চাকরি পেয়েছেন লাইজু। লাইজুর বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কাজুলিয়া গ্রামে। একই গ্রামে বাড়ি ডিএসসিসির সদ্য সাবেক সচিব আকরামুজ্জামানের। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তার বোন রোজিনা বেগমের মেয়ে লাইজু। সিটি করপোরেশনে চাকরিপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, মূলত মামা আকরামুজ্জামানের সাচিবিক আদেশে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন লাইজু। শুধু ভাগ্নি লাইজু নন, সাবেক সচিব আকরামুজ্জামান কর্মরত থাকাকালে আরও আটজন আত্মীয়স্বজন সিটি করপোরেশনে চাকরি পেয়েছেন। নিয়োগপ্রাপ্ত শুধু ভাগ্নি জামাইয়ের বাড়ি নড়াইলে। বাকি আটজনের বাড়িই গোপালগঞ্জে বলে জানা গেছে। তবে তারা বিভিন্ন জায়গার ঠিকানা দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। আকরামুজ্জামান নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব হয়ে আত্মীয়স্বজনদের নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের এমন ঘটনায় দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ বোর্ডে থাকা কোনো কর্মকর্তার স্বজন চাকরিপ্রত্যাশী হলে তাকে ওই নিয়োগ বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু সাবেক সচিব নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব ছিলেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি একজন কর্মকর্তার ৯ জন আত্মীয়স্বজনকে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন, এখানে যে স্বজনপ্রীতি হয়েছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, লাইজু খানমের বোন লিনা খানম ও ভাই মুশফিক উস শালেহীনও চাকরি করছেন ডিএসসিসিতে। চলতি বছরের ১২ মে রেজিস্ট্রেশন সহকারী (জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধীকরণ) পদে যোগদান করেছেন লিনা। আর কার্যসহকারী পদে গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি যোগদান করেছেন মুশফিক। আকরামুজ্জামানের আরেক ভাগ্নি হামিমা খানম প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মী পদে নিয়োগ পেয়েছেন চলতি বছরের ১৩ মে। শুধু ভাগ্নে-ভাগ্নি নয়, আকরামুজ্জামানের প্রভাবে চাকরি পেয়েছেন তার ভাগ্নি জামাই মো. শাহীন মোল্ল্যা। তার বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার কচুয়াডাঙ্গা গ্রামে। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক পদে ডিএসসিসির সচিবের দপ্তরে যোগদান করেছেন শাহীন। সাবেক সচিব আকরামুজ্জামানের চার চাচাতো ভাইও নিয়োগ পেয়েছেন সিটি করপোরেশনে। ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রেন্ট অ্যাসিসটেন্ট পদে যোগদান করেছেন মারুফ হাওলাদার। ইপিআই সুপারভাইজার পদে চলতি বছরের ১৯ মে যোগদান করেছেন মো. শাকিল আহম্মেদ। ২০২২ সালের ২১ আগস্ট স্প্রেম্যান সুপারভাইজার পদে যোগদান করেছেন ছাব্বির আহমেদ। পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক পদে গত ২ জুন যোগদান করেছেন সোহাগ হাওলাদার। এর মধ্যে তথ্য গোপন করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে একসঙ্গে সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন সোহাগ। তিনি গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) কার্যালয়ের অফিস সহায়ক পদেও কর্মরত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের মে মাসে শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর আকরামুজ্জামানকে প্রেষণে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব করা হয়। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি নগর ভবনে আসা বন্ধ করে দেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তাকে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডে বদলি করা হয়েছে। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, তাপস মেয়র থাকার সময় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন পদে কাকে নেওয়া হবে, সেটি তিনি নিজেই চূড়ান্ত করতেন। এরপর তার পছন্দের প্রার্থীদের তালিকা সিটি করপোরেশনের সচিব আকরামুজ্জামানের কাছে দিতেন। সে অনুযায়ী নিয়োগের ব্যবস্থা করতেন তিনি। বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার খাতাও তিনি দেখতেন। সাবেক মেয়রের কথামতো নিয়োগের পুরো বিষয় তত্ত্বাবধান করতেন তিনি। মেয়রকে ম্যানেজ করেই আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দিয়েছেন আকরামুজ্জামান। তার আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই চাকরি পেয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার দু-একজন লিখিত পরীক্ষায় পাস না করেও চাকরি পেয়েছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে আকরামুজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তা তার স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন, এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। অনিয়ম করে নিয়োগের বিষয়ে কোনো অভিযোগ এলে সেটি তদন্ত করে দেখা হবে। এমন অনিয়মের বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একাধিক কারণে এই নিয়োগে অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে। সরকারি একজন কর্মকর্তার ৯ জন আত্মীয়স্বজনকে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন, এখানে যে বাস্তবে স্বজনপ্রীতি হয়েছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এটিকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দেখানোর জন্য প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এখানে স্বজনপ্রীতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতা ব্যবহারের যে ঘটনা ঘটেছে, তা একজন সরকারি কর্মকর্তা করতে পারেন না। সরকারি কর্মকর্তাদের যে নৈতিক আচরণবিধি তার সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক। এমনকি নিয়োগ বোর্ডে থাকা কোনো কর্মকর্তার স্বজন চাকরিপ্রত্যাশী হলে তাকে ওই নিয়োগ বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতে হয়। তিনি আরও বলেন, এই নিয়োগের সঙ্গে সংস্থাটির ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ, মেয়রসহ অন্য যারা ছিলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তারা সবাই দায়ী। তাদের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত কখনো এককভাবে হয় না। করপোরেশনের শীর্ষপদে যিনি ছিলেন, মেয়র, তিনি নিজেই বিভিন্নভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তি যখন ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, তার অধীনরাও তা করতে বাধ্য হন।