‘চাপ’ যখন ভেতর ও বাইরের


এমন কথা চালু আছে যে ওটা ছিল ‘আসন সমঝোতার’ নির্বাচন। সেটাও হীন রাজনৈতিক বিষয়–যদিও অনেকে বলছে, ওই সমঝোতা কার্যকর করা গেলেও দেশে একটা মোটামুটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ পাওয়া যেত। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের সুযোগও হয়তো তৈরি হতো সেই পথ ধরে। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই সংশ্লিষ্ট মহলগুলোয় একটা দুশ্চিন্তা ভর করেছে। সেটা আতঙ্কে রূপ নিচ্ছে বলেই মনে হয়। ‘ভোট-নিষেধাজ্ঞায় ফিসফাস জনপ্রশাসনে’। এর দুদিন আগে অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও জব্দ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে’। দুটি প্রতিবেদনই বেরিয়েছে প্রথম পৃষ্ঠায়। সেগুলোর প্রাসঙ্গিক অংশটুকু নিবন্ধের শেষে ব্যবহার করব। বিশেষ ভিসা নীতি ঘোষণার বেশ কয়েক মাস আগে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত এলিট ফোর্স এবং তার কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগেই ওই নিষেধাজ্ঞা আসে। আগে দেশের ভেতর থেকে যে এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ তোলা হয়নি, তা কিন্তু নয়। সেটা কেবল বিরোধী দলের তরফ থেকে তোলা হয়েছে, তা-ও নয়। মানবাধিকার সংগঠন, ভুক্তভোগী পরিবার এবং তারপর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা থেকেও বারবার বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের। ন্যায়সংগত প্রতিবাদ রচনাও এখানে সহজ নয়। রীতিমতো আইন করে সেটা নিয়ন্ত্রণের বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগমুহূর্তে। সেটাও অবশ্য সম্প্রতি ‘বাতিলের’ ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এর জায়গায় নতুন কী আইন প্রণীত হবে, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে। আছে সন্দেহ-অবিশ্বাস। এ রকম একটা জায়গায় আমরা পৌঁছে গেছি দুর্ভাগ্যবশত। আইন আদৌ জনস্বার্থে প্রণীত হবে কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়েছে অভিজ্ঞতার কারণেই। এটা আরও এ জন্য যে, সরকার বা এর কোনো সংস্থার কাজে দেশের ভেতর থেকে আপত্তি উঠলেও তা গুরুত্ব পায় না। সেটা ঠিকই গুরুত্বপূর্ণ, অনেক ক্ষেত্রে অলঙ্ঘনীয় হয়ে ওঠে বাইরে থেকে ‘চাপ’ হিসেবে এলে। সরকার অবশ্য প্রায়ই বলে থাকে, তারা কোনো ‘চাপ অনুভব’ করছে না। তবে আমরা দেখেছি, এলিট ফোর্সের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার পর তার বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারসহ আইনবহির্ভূত পদক্ষেপ গ্রহণের অভিযোগ অনেক কমে এসেছে। সম্প্রতি বিরোধী দলের এক দফার আন্দোলন মোকাবিলায়ও তাদের রাজপথে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের দিয়ে যেভাবে এটা মোকাবিলার চেষ্টা হচ্ছে, তা নিয়েও জোর আপত্তি এসেছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে। এতেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়। কথা হলো, কেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে ‘চাপ’ আসতে হবে? দেশের ভেতর থেকে ওঠা প্রতিবাদ কেন ‘চাপ’ বলে বিবেচিত হবে না? কোন ক্ষেত্রে কীভাবে কী করতে হবে প্রশাসনকে–সেই নির্দেশনা কি দেশের আইন আর বিধিবিধানে নেই? কার্যত সেগুলোর কত শতাংশ অনুসৃত হচ্ছে, সে প্রশ্ন সংগত কারণেই ওঠে। এলিট ফোর্সের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাটা তোলা হলো এটা বলতে যে তখন থেকেই স্পষ্টভাবে ‘চাপ’ আসতে শুরু করেছে—এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষত রাজনৈতিক অঙ্গনে, সেখান থেকে বেরোতে তখন থেকেই সরকারের উচিত ছিল সিরিয়াস হওয়া। এটা যে শুধু মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা উপলব্ধি করে উচিত ছিল আগামী নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সব অংশীজনকে একটা বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। নির্বাচনটি যে এবার ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতেই হবে, সে উপলব্ধি আসা দরকার ছিল প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারির ঘটনাতেই। তা হয়নি। হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের কাজের ধারায়ও পরিবর্তন আসত। তাহলে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলায় তাকে কীভাবে কী করতে হবে, সে ‘নির্দেশনা’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে আসার প্রয়োজন হতো না এত দিন পর। বিরোধী দলের কর্মসূচির দিন নিয়ম করে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টাও মনে হয় এখন বাদ দিতে হবে। অথচ এর সবই দেশের ভেতর থেকে অব্যাহতভাবে বলা হয়েছে এত দিন। বিরোধী দল তো একনাগাড়ে প্রতিবাদ জানিয়ে গেছে। অতীতে ক্ষমতায় থাকতে তারাও কমবেশি একইভাবে প্রশাসন ও দল পরিচালনা করেছিল বলে তাদের ওপর চলমান এ অন্যায়কে তো সঠিক বলা যায় না। বিশেষ করে ভিসা নীতি ঘোষণার সময় প্রথমদিকে যা-ই বলা হোক, ক্রমে বোঝা যাচ্ছে–এতে সরকার ও প্রশাসনের ওপর ‘চাপ’ বেড়েছে কতটা। নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস আগে এ ধরনের নীতি ঘোষণায় বুঝতে কষ্ট হয় না, যুক্তরাষ্ট্র এখানে কেমন নির্বাচন চায়। তাদের চাওয়াটা অবশ্য এত গুরুত্ব পেত না, যদি এ দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে সেটা না যেত। সংবিধানেও কি দেশের সকল পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর দেওয়া হয়নি? সত্যি বলতে, দু-দুটি অগ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় পর্যায়েও নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পেশাজীবী সংগঠনেও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হয় না বললেই চলে। রাষ্ট্র ও সমাজে এর বহুমুখী ক্ষতিকর প্রভাবের কথা কে অস্বীকার করতে পারে? রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও এতে অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জনপ্রশাসন। পুলিশও এর বাইরে নয়। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে ভিসা নীতির আওতায় পড়ে যাওয়ার বিষয়ে ‘অস্বস্তি’ শুরুর খবর অবশ্য এর আগেও এসেছে মিডিয়ায়। তবে আলোচ্য প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। একজন পদস্থ কর্মকর্তা মার্কিন দূতাবাসে ভিসা চাইতে গেলে তাঁকে দীর্ঘ সময় যেভাবে জেরা করা হয়, তাতে তিনি রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। সে ঘটনা বর্ণনা করেছেন সমপর্যায়ের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক ঘরোয়া বৈঠকে; বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যে ভূমিকা পালনের কথা আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাতে তাঁদের অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়াটা তো এখন বিচিত্র নয়। কথা হলো, তাঁদের ওই ধরনের ভূমিকা গ্রহণ কি আইনসম্মত ছিল? যাঁরা তাঁদের ওই ভূমিকা পালনে প্ররোচিত বা বাধ্য করেছিল, তারাও কি সেটা করার অধিকার রাখে? এমন কথা চালু আছে যে ওটা ছিল ‘আসন সমঝোতার’ নির্বাচন। সেটাও হীন রাজনৈতিক বিষয়–যদিও অনেকে বলছে, ওই সমঝোতা কার্যকর করা গেলেও দেশে একটা মোটামুটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ পাওয়া যেত। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের সুযোগও হয়তো তৈরি হতো সেই পথ ধরে। এর বদলে কী ঘটেছে, তা আমরা জানি। এখন দেশের ভেতর বিরোধীরা শুরু করেছে এক দফার আন্দোলন। বাইরে থেকে প্রভাবশালী দেশ আর সংস্থার ‘চাপ’ও ক্রমেই বাড়ছে এবং সেটা স্পষ্টতই নির্বাচন ঘিরে। এই নিবন্ধ লেখার সময় দুই কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। দুজন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই দল থেকে নির্বাচিত হলেও তাঁরা এসেছেন অভিন্ন কাজে। এটা হলো ওই সব দেশের ‘গণতন্ত্রের সৌন্দর্য’, যা থেকে আমরা বেদনাদায়কভাবে বঞ্চিত আছি স্বাধীনতার এত বছর পরও। যা-ই হোক, তাঁরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করতে এলেও নির্বাচন সম্পর্কে জানা-বোঝারও চেষ্টা করবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন তাঁরা। এর আগে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সফর করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়কারী। আগেভাগে অত বোঝা না গেলেও তাঁর সফর চলাকালে বোঝা গেছে এর গুরুত্ব। একটি সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি স্পষ্ট করেছেন, বাংলাদেশে চলমান দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং এ-সংক্রান্ত আইন ও পদক্ষেপ খতিয়ে দেখতেই তিনি এসেছিলেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেও দিয়েছেন তাঁর কাজ সম্পর্কে ধারণা। মূলত এতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্নীতিবাজদের মধ্যে। তাঁরা শুধু ভিসা নিষেধাজ্ঞা নয়; পাচার করা অর্থসম্পদ জব্দ হওয়ার আতঙ্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন—এ বিষয়ে ভালো জানাশোনা আছে, এমন লোকজনের কাছে। সে বিষয়েই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সহযোগী দৈনিক। একটি আলোচিত বিজনেস গ্রুপের বড় অর্থ পাচার-সম্পর্কিত প্রতিবেদনও এসেছে আরেক ইংরেজি দৈনিকে–একই সময়ে। এগুলোর কোনোটাই উদ্দেশ্যহীন বলে মনে হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু বেপরোয়া দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা অর্থ পাচার নিয়ে আলোচনা কি হয়নি দেশের মধ্যে? এটা কি নতুন কিছু? সাবেক অর্থমন্ত্রীও কি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেননি? শেষে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও বলতে হচ্ছে, বিদেশে দুর্নীতিবাজদের সম্পদ জব্দ হলে তিনি বরং খুশি। হায়, ব্যাপারটা যদি ব্যক্তিবিশেষের খুশি আর অখুশির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত! হাসান মামুন লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক