দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপের কার্যক্রম আজ থেকে শুরু করতে যাচ্ছে বিএনপিসহ সমমনা ৩৭ দলের বিরোধী জোটগুলো। তবে এ যাত্রায় দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াত নেই। আজ বুধবার রাজধানীতে সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যুগপৎভাবে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি এবং ‘রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা যৌথ রূপরেখাও’ ঘোষণা করা হবে। দুপুরে নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বড় সমাবেশ থেকে এই ঘোষণা দিবে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই ঘোষণা দিবেন। আগামী শুক্রবার ঢাকাজুড়ে মানববন্ধন বা মানবপ্রাচীর অথবা বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এক দফার আন্দোলনের সূচনা হতে পারে।
মিত্ররা কোথায় কীভাবে ঘোষণা করবে : গণতন্ত্র মঞ্চ বিকাল ৪টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে অভিন্ন এক দফা, নতুন কর্মসূচি ও রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করবে। এছাড়া ১২ দলীয় জোট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বিজয়নগর পানির ট্যাংকিসংলগ্ন আল-রাজি কমপ্লেক্সের সামনে, এলডিপি তেজগাঁওয়ে এফডিসিসংলগ্ন দলীয় কার্যালয়ে, গণফোরাম-বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) আরামবাগে দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে, এনডিপি বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে, লেবার পার্টি নয়া পল্টনে মসজিদ গলিতে দলীয় কার্যালয়ে, গণ অধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া) জাতীয় প্রেস ক্লাবে, গণ অধিকার পরিষদ (নুরুল হক নুর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে এবং গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, সমমনা গণতান্ত্রিক পেশাজীবী জোট ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিকাল তিনটায় এই ঘোষণা দেবে।
এদিকে এই প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী নেই বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। জানা গেছে, তারা আপাতত একলা চল নীতিতে চলছে। দলটি এই মুহূর্তে আগামী ১৫ জুলাই সিলেটের জনসভার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। এরপর অন্যান্য বিভাগ ও মহানগরেও এককভাবে সমাবেশ করবে জামায়াত। যা থাকছে এক দফায় : সরকারের পদত্যাগই এক দফার মূল বিষয়। তবে এর সঙ্গে আরও কয়েকটি দাবিও থাকছে। এক দফার শিরোনাম করা হয়েছে- ‘যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের ১ দফার যৌথ ঘোষণা’।
এখানে থাকছে- বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি; নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনঃগঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা; বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ১ দফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দলসমূহ যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা ও সফল করা।
এক দফার আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বুধবার আমরা একটা যৌথ ঘোষণা দেব। যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে সেই ঘোষণা দেবে। একই সময় দেবে, একই ঘোষণা আসবে। আমরা মনে করি- এ রকম একটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতি আশান্বিত হবে, উজ্জীবিত হবে। আন্দোলন আরও শক্তিশালী-বেগবান হয়ে এই সরকারের পতন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’
বিএনপির সূত্র জানিয়েছে, এক দফার আন্দোলনের যাত্রাকে রাজনৈতিকভাবে অর্থপূর্ণ করতে সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগমের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দলীয় কার্যালয়ের সামনে এযাবৎ সর্ববৃহৎ সমাবেশ থেকে এক দফার ঘোষণা দিতে চায় বিএনপি। এ লক্ষ্যে এক সপ্তাহ ধরে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, ঢাকা মহানগর, জেলা ও বিভাগীয় নেতাদের সঙ্গে প্রস্তুতি সভা করেছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এছাড়া বিগত জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা বিভাগের অধীন প্রতিটি সংসদীয় আসনে ধানের শীষের প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া প্রথম দু’জন প্রার্থীকে নিয়েও প্রস্তুতি সভা করেছেন বিএনপির হাইকমান্ড। এসব সভায় ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জনসমাগম বাড়াতে বিশেষভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান বলেন, ‘আমাদের এই সমাবেশ হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। এজন্য আমরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছি। আশা করছি, ইনশাল্লাহ এই সমাবেশ জনসমুদ্রে রূপ নেবে। ঢাকার জনগণ রাজপথে তাদের দাবি নিয়ে আসবে। এই সমাবেশ থেকে যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে তা বাস্তবায়ন হলে জনগণ তার ভোটাধিকার ফিরে পাবে এবং জনগণের একটি সরকার প্রতিষ্ঠা হবে বলে আমরা মনে করি।’ তিনি জানান, ‘এই সমাবেশ যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হয়, সেজন্য আমরা অনেকগুলো স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করেছি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে আমরা সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ঢাকায় সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের আগে বড় জমায়েতের মাধ্যমে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে এই সমাবেশ সম্পন্ন করতে চান বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর নজর রাখা আন্তর্জাতিক মহলকে ‘বিশেষ বার্তা’ দিতে চায় দলটি। সেটি হলো-সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায় করা। তাই এক দফার সমাবেশ থেকে শান্তিপূর্ণ ধারাবাহিক কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে। আর ব্যাপক জনসমাগমের মাধ্যমে ইইউ প্রতিনিধি দলকে বিএনপি এই বার্তা দিতে চাইছে যে, তাদের অবস্থান ও দাবির প্রতি মানুষের সমর্থন রয়েছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, ৩৬টি বিরোধী দল একযোগে এক দফার ঘোষণা দিলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর সাড়া পড়বে। আর এর মধ্য দিয়ে তারা যে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে- ইইউসহ আন্তর্জাতিক মহলকে সে বার্তাও দিতে চায় দলটি।
নতুন কর্মসূচির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, অহিংস পথেই চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা করতে চায় বিএনপিসহ মিত্ররা। সে কারণে হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে যেতে চায় না তারা। এক দফা আন্দোলনের মূল ফোকাস হবে ঢাকা। তাই এক দফার সমাবেশ থেকে ঢাকাকে ঘিরে সিরিজ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। আর আগামী শুক্রবার ঢাকাজুড়ে মানববন্ধন বা মানবপ্রাচীর অথবা বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এক দফার আন্দোলনের সূচনা হতে পারে। এরপর পর্যায়ক্রমে পদযাত্রা, সমাবেশ, বিক্ষোভ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, অবস্থান ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি আসতে পারে। শান্তিপূর্ণ এসব কর্মসূচিতে জনগণকে ব্যাপক হারে সম্পৃক্ত করাই বিএনপির লক্ষ্য। আর আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঢাকামুখী লংমার্চ, রোডমার্চ, চলো চলো ঢাকা চলো, সচিবালয় ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও, গণভবন ঘেরাও, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও, ঢাকা ঘেরাওয়ের সঙ্গে ঢাকায় লাগাতার অবস্থানের কর্মসূচি আসতে পারে। এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশে গণ-অভ্যুত্থান পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দাবি আদায় করতে চান বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। এরপর ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার বাইরে এবং ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিলের মধ্য দিয়ে মাঠে গড়ায় তাদের আন্দোলন। এখন পর্যন্ত গণমিছিল, গণঅবস্থান, মিছিল, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এছাড়া বিএনপির এই মুহূর্তে ঘোষিত কিছু কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জুলাই খুলনায় ও ২২ জুলাই ঢাকায় ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ রয়েছে। জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল এই সমাবেশ করছে। এছাড়া ১৪ জুলাই নোয়াখালীতে পদযাত্রা করবে কৃষক দল, শ্রমিক দল, তাঁতী দল, মৎস্যজীবী দল ও জাসাস। নোয়াখালীর পর ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম, ১৯ জুলাই দিনাজপুর, ২৮ জুলাই রাজশাহী, ৫ আগস্ট যশোর, ১২ আগস্ট হবিগঞ্জ ও ১৯ আগস্ট বরিশালে পদযাত্রা হবে। এসব কর্মসূচির সঙ্গে এক দফা আন্দোলনও চলবে। এছাড়া আগামী ১৯-২১ জুলাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ করবে গণতন্ত্র মঞ্চ। এসব কর্মসূচি শেষ হলে তারপর থেকে সব কর্মসূচি যুগপৎভাবে পালিত হবে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।