জিম্মিদের মুক্তিতে লাগতে পারে ২ থেকে ৩ মাস


সোমালিয়া উপকূলে আটকে রাখা বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ পাহারা দিচ্ছে ১২ জলদস্যু। চার দিন পার হলেও শুক্রবার রাত পর্যন্ত দস্যুরা তাদের কোনো দাবি-দাওয়া জানায়নি। জাহাজ ও নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার ও মালিকপক্ষ। তবে ধারণা করা হচ্ছে, সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নাবিকদের মুক্ত করতে লেগে যেতে পারে ২ থেকে ৩ মাস। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স-ইইউএনএভিএফওআর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, তারা এ ঘটনার ওপর নজর রাখছে। জলদস্যুদের তিনটি সম্ভাব্য ক্যাম্পও চিহ্নিত করেছে তারা। এদিকে যতই দিন যাচ্ছে ততই জিম্মি নাবিকরা যেমন সেখানে রয়েছেন জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কায়, তেমনি দেশে তাদের পরিবারেও বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। স্বজনদের কবে ফিরে পাবেন, জাহাজের মালিকপক্ষ কী করছে তা নিয়েও তাদের মধ্যে রয়েছে নানা জিজ্ঞাসা। শামসুদ্দিন নামে এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি এক নাবিক (অয়েলার) তার ভয়েস মেসেজে বলেছেন, সিকিউরিটি না নেওয়ার কারণেই হয়তো তারা দস্যুর কবলে পড়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স-ইইউএনএভিএফওআর বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ছিনিয়ে নেওয়ার সময় এমভি আবদুল্লাহতে ২০ জন সশস্ত্র জলদস্যু থাকলেও জাহাজ থেকে পাওয়া সবশেষ ভিজ্যুয়াল তথ্যে দেখা যায়, এতে অন্তত ১২ জন দস্যু আছে। ইইউএনএভিএফওআর তাদের সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, অপারেশন আটলান্টার আওতায় বাংলাদেশি পতাকাবাহী পণ্যবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জলদস্যুতার শিকার হওয়ার ঘটনাটিতে তারা নজর রাখছে। কিছুদিন আগে ওই অঞ্চলে ‘এমভি রুয়েন’ নামের আরেকটি জাহাজ জলদস্যুতার শিকার হয়েছিল। ওই জাহাজটি যারা ছিনিয়ে নিয়েছিল সেই একই জলদস্যু গ্রুপ এমভি আবদুল্লাহর ঘটনায় জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, সোমালি উপকূলের উত্তর, দক্ষিণ আর মধ্য অঞ্চলে সোমালিয়ার জলদস্যুদের তিনটি সম্ভাব্য ক্যাম্প চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ক্যাম্প থেকেই জলদস্যুরা জাহাজ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযানে সহায়তা করে থাকে। এমভি আবদুল্লাহ চট্টগ্রামভিত্তিক কবীর গ্রুপের (কেএসআরএম) সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দস্যুদের যে দলটি জাহাজ ছিনতাই করেছিল, তারা জাহাজ থেকে নেমে গেছে। তাদের স্থলে জিম্মিদের পাহারা দেওয়ার জন্য দস্যুদের নতুন আরেকটি দল যোগ দিয়েছে। জাহাজটি যেখানে নোঙর করা হয়েছিল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত সোমালিয়ার সেই গ্যারাকাড উপকূলেই ছিল। শুক্রবার বিকালের দিকে জাহাজটিকে দস্যুরা আগের অবস্থান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করে। তবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হয়তো দস্যুরা ওই এলাকাকে নিরাপদ মনে করছে না। তাই অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। সূত্রমতে, জিম্মি নাবিকদের প্রথমে একটি কেবিনে আটকে রাখলেও এখন নিজ নিজ কেবিনে যেতে দেওয়া হচ্ছে। নাবিকরা নিরাপদে আছেন। দস্যুরা এখনো জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। মালিক কর্তৃপক্ষ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি জিম্মি দশা থেকে মুক্ত করতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে। বিশ্বে এ ধরনের ৫০-৬০টি প্রতিষ্ঠান বা ক্লাব রয়েছে যারা দস্যুদের হাত থেকে জিম্মি মুক্তিতে মধ্যস্থতা করে থাকে। এর আগে ২০১০ সালে এসআর শিপিংয়ের ‘জাহান মণি’ নামে অপর একটি জাহাজ জিম্মি করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। নানামুখী চেষ্টায় ৯৯ দিন পর ওই জাহাজের নাবিকরা মুক্তি পেয়েছিলেন। পরে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। জিম্মি এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের ফিরিয়ে আনতেও কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস লাগতে পারে বলে মনে করছেন শিপিং সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মুক্তির প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি ও কিছুটা জটিল। এটা কোনো একক পক্ষের কাজ নয়। মুক্তি প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো পক্ষ শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে যায়। তবে আশার কথা হলো, একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জাহাজ এর আগে জিম্মি হয়েছিল। তারা ওই জাহাজের নাবিকদের মুক্ত করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এক্ষেত্রে তারা পুরোনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবে। তাই তাদের ওপর আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকেও বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। নাবিকদের মুক্ত করতে অনেকগুলো ধাপ পার হতে হবে উল্লেখ করে তিনি জানান, এসব ক্ষেত্রে জলদস্যুরা প্রথমে জাহাজ মালিকের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর এ নিয়ে দরকষাকষি শুরু হয়। উভয় পক্ষ একমত হলে টাকা পরিশোধের প্রশ্নটি আসে। কোনো ব্যাংকিং চ্যানেলে মুক্তিপণের টাকা লেনদেন হয় না। দস্যুরা সাধারণত নগদ ডলার দাবি করে। তাদের নির্দিষ্ট স্থানে অর্থ পৌঁছে দিতে বলে। হাতে হাতে সেই অর্থ না পাওয়া পর্যন্ত তারা জিম্মিদের ছাড়ে না। মুক্তিপণ পরিশোধের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। দস্যুরা যেভাবে যে স্থানে পৌঁছাতে বলে, সেভাবেই নির্দেশনা অনুসরণ করতে হয়। আবার জাহাজের মালিক পক্ষও নিশ্চয়তা চায় যে, মুক্তিপণ সঠিক লোকদের দেওয়া হচ্ছে কিনা, অর্থ পাওয়ার পর নাবিকদের ছেড়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা কতটুকু। আবার অনেক সময় দেখা যায়, সব শর্ত ঠিকঠিক কিন্তু হঠাৎ করেই জলদস্যুরা আবার নতুন শর্ত জুড়ে দেয়। তিনি আরও জানান, এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের মুক্ত করতে অন্তত দুই থেকে তিন মাস লেগে যেতে পারে। যদি এর আগে মালিকপক্ষ মুক্ত করে আনতে পারে, তা হবে অনেকটাই ব্যতিক্রম ও বড় ধরনের সাফল্য। এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহেরুল করিমও একই আভাস দিয়েছেন। তিনি জানান, এখনো পর্যন্ত জলদস্যুদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়নি। তারা মুক্তিপণ চায়নি এখনো। মুক্তিপণ দাবিতে তারা কিছুটা সময় নেয়। আমরা অপেক্ষায় আছি। উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে বিপ্লবের পরিবারের : দাগনভূঞা (ফেনী) প্রতিনিধি জানান, ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ২৩ নাবিকের মধ্যে রয়েছেন দাগনভূঞার ইব্রাহিম খলিল উল্যাহ বিপ্লব। তিনি কেমন আছেন তা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে পরিবারের সদস্যদের। শুধু পানিপান করে রোজা রাখছেন স্ত্রী উম্মে সালমা, বাবা আবুল হোসেন ও মা রৌশন আরা। উম্মে সালমা বলেন, জলদস্যুরা বিপ্লবের মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়েছে। তবে ব্যাগে একটি পুরোনো মোবাইল ছিল। সেটি দিয়ে সর্বশেষ বুধবার সকালে ফোন দিয়েছিল। তবে খুব বেশি কথা বলার সুযোগ হয়নি। বিপ্লব ফোনে দুই ছেলে রেদওয়ান ও রিহানের কথা জানতে চান। তার জন্য দোয়া করতে বলেন। বিপ্লব দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের মোমারিজপুরের আবুল হোসেনের ছেলে। ফেনী শহরের নাজির রোডে ভাড়া বাসায় থাকে তার পরিবার। ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন : জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর সহায়তায় যুদ্ধজাহাজ এবং একটি দূরবর্তী টহল জাহাজ (এলআরএমপি) মোতায়েন করেছে ভারতের নৌবাহিনী। শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে ভারতীয় নৌবাহিনী এ তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি জাহাজটি জলদস্যুর কবলে পড়ার খবর পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে দূরবর্তী টহল জাহাজ (এলআরএমপি) মোতায়েন করা হয়। এরপর ১২ মার্চ সন্ধ্যায় জাহাজের অবস্থান শনাক্ত করার পর জাহাজের নাবিকদের অবস্থা জানতে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু জাহাজ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। ওই পোস্টে আরও বলা হয়, এ ঘটনায় পরে ভারতীয় নৌবাহিনী একটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। সেটি ওই অঞ্চলে সামুদ্রিক নিরাপত্তায় কাজ করছিল। যুদ্ধজাহাজটি ১৪ মার্চসকালে ছিনতাইকৃত জাহাজের গতিপথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।