ডলারের প্রভাবে দেশে কমেনি পণ্যের দাম


আন্তর্জাতিক বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে কমছে না। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় আমদানি খরচ বেশি হচ্ছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশের বাজারে কমছে না পণ্যের দাম। ফলে দেশের ভোক্তারা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে এর সুফল না পাওয়ার আরও কারণ হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশের বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ইত্যাদি। এসব কারণে দেশে পণ্যমূল্য বেড়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হারও হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে পণ্যমূল্য কমার তথ্যও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চাল ও চিনি দাম বেড়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে। বাকি প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম গত দেড় বছরের ব্যবধানে নিম্নমুখী। তারপরও দেশের বাজারে এর সুফল মিলছে না। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এরপর থেকে বৈশ্বিকভাবে প্রায় সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। এতে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এর প্রভাবে দেশের বাজারে পণ্যের দাম হুহু করে বেড়ে যায়। একই সঙ্গে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় কমে যায়। এর প্রভাবে ডলার খরচ বাড়ে, কিন্তু আয় কমে। বাধ্য হয়ে বাড়তি খরচ মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দেওয়া হয়। এতে রিজার্ভ কমতে থাকে। ফলে ডলারের সংকটের কারণে এর দাম বাড়তে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম কমেছে। এতে বৈশ্বিকভাবে আমদানি খরচও কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে পণ্যের দাম কমছে না। বরং বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার সুফল দেশের ভোক্তারা না পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও টাকার মান কমে যাওয়া। ডলারের দাম বাড়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও আমদানি খরচ বেশি পড়ছে। কারণ বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। এতে পণ্যের দাম কমছে না। এর পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশের বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিও দায়ী। এসব কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশের বাজারে পণ্যমূল্য না কমে বরং বেড়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হারও হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। বৈশ্বিকভাবে রাশিয়া ও ইউক্রেন যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের জোগান দিয়ে থাকে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার ওপর মার্কিন ও ইউরোপের অবরোধ আরোপের কারণে রাশিয়া থেকে পণ্যের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকেও পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয়। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। ওই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পণ্যের দাম বাড়ে। এরপর থেকে কমতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিকভাবে উৎপাদন কম হওয়ায় চাল ও চিনির দাম বাড়ছে। বাকি সব পণ্যের দাম যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের তুলনায় কমেছে। প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সয়াবিন তেলসহ ভোজ্যতেলের বড় জোগানদার রাশিয়া ও ইউক্রেন। ২০২২ সালের জুনে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের প্রতি টনের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮৮৭ ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ১ হাজার ১২৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে দাম কমেছে ৭৬৩ ডলার বা ৪০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। একইভাবে গমের সবচেয়ে বড় জোগানদারও ওই দুটি দেশ। ২০২২ সালের জুনে প্রতি টন গমের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ৪১৫ ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ২৩৭ ডলারে নেমেছে। আলোচ্য সময়ে দাম কমেছে ১৭৮ ডলার বা ৪৩ শতাংশ। ভোজ্যতেল ও শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় পাম অয়েল। এটির সবচেয়ে বড় জোগানদার মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়া থেকেই সবচেয়ে বেশি পাম অয়েল আমদানি করে। ওই দেশ থেকে বাংলাদেশে পাম অয়েল আমদানিতে যুদ্ধের কোনো প্রভাব নেই। তারপরও সয়াবিনসহ অন্যান্য ভোজ্যতেলের জোগান কমে যাওয়ায় পাম অয়েলের দাম বেড়ে যায়। ২০২২ সালের জুনে প্রতিটন পাম অয়েলের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৩৩ ডলারে ওঠে। এখন তা কমে ৮৫০ ডলারে নেমেছে। আলোচ্য সময়ে দাম কমেছে ৭৮৩ ডলার বা ৪৮ শতাংশ। এছাড়া ডাল, মাংস, দুধ, ফলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে কমেনি। উল্টো আরও বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে জ্বালানি তেলের উল্লেখযোগ্য জোগান আসে। যুদ্ধের পর থেকে জ্বালানি তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে এর দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১২৭ ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ৮২ ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে দাম কমেছে ৪৫ ডলার বা ৩৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে ওইসব পণ্যের দাম কমায় ডলারে আমদানি খরচ কমেছে। ফলে দেশের বাজারে এগুলোর দাম কমার কথা। কিন্তু টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। এখন তা বেড়ে নির্ধারিত দাম ১১০ টাকা ও ব্যাংকগুলোতে সর্বোচ্চ ১২৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৪১ টাকা। অর্থাৎ ডলারের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪৮ শতাংশ। এ কারণে বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি করতে হয়। যে কারণে আমদানি খরচ বেশি পড়ছে। এতে দেশের বাজারে পণ্যের দাম না কমে বরং বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম এখনো সর্বোচ্চ পর্যায় রয়েছে। প্রতিটন চল এখন সর্বোচ্চ ৬০০ ডলার। ২০২২ সালের জুনে ছিল ৪৪৬ ডলার। দেশে চালের আমদানি একেবারেই কম। তারপরও দেশে চালের দাম হুহু করে বেড়েছে। চিনির দামও বেড়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিকেজি চিনি ৪৩ সেন্ট থেকে বেড়ে এখন ৫৪ সেন্টে উঠেছে। ফলে দেশের বাজারেও চিনির দাম বাড়ছে। বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের দাম কমা ও ডলার সংকটে আমদানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় খাদ্যপণ্যের আমদানিও কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে খাদ্যপণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৪১৬ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছে ৩২৩ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে এ খাতে আমদানি ব্যয় কমেছে সাড়ে ২২ শতাংশ। একই সঙ্গে নতুন এলসি খোলা কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার অন্যতম কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন। তবে অবমূল্যায়নের কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে ও রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়িয়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মানকে স্থিতিশীল করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ, ২০২২ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশে। গত অক্টোবরে তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে ওঠে। গত ডিসেম্বরে তা কমে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশে নেমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও শুধু ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে সাম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেলের উৎপাদকরা এর দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। সরকার এখনো দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়নি। তবে ব্যবসায়ীদের চাপ রয়েছে। অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ার নেপথ্যে ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখানো হচ্ছে। তবে ডলারের দাম যেটুকু বেড়েছে, তার চেয়ে পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে কমেনি। এর জন্য বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিকে দায়ী করা হয়েছে।