ডলার সংকটের ক্ষত অর্থনীতির সর্বত্র
অনলাইন নিউজ ডেক্স
দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে গত পৌনে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সংকট। এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে গত বছরের আগস্ট থেকে। এ হিসাবে ৬ মাস ধরেই সংকট তীব্র। এতে সব ধরনের আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে আমদানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর ক্ষত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাবে ডলারের দাম বেড়েছে। নিয়ন্ত্রণের ফলে সব ধরনের আমদানি কমেছে। এতে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে দাম বেড়েছে। শিল্প খাতের সব উপকরণ আমদানি কমায় উৎপাদন ও নতুন শিল্প স্থাপন হ্রাস পেয়েছে, কমেছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ। এতে নতুন কর্মসংস্থানের গতিও মন্থর হয়ে পড়েছে। বেড়েছে সব পণ্যের দাম ও মূল্যস্ফীতি, কমেছে মানুষের জীবনযাত্রার মান। বেড়েছে বিদেশি দায়দেনা, কমে গেছে টাকার মান।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন আক্রমণ করলে বৈশ্বিক সংকটের শুরু হয়। এতে বৈশ্বিকভাবে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর বলে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। এতে ডলারের সংকট দেখা দেয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঊর্ধ্বগতিতেও লাগাম পড়ে। সে পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ওই বছরের ১১ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারি করা এক সার্কুলারে শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট আমদানি ছাড়া অন্যান্য সব পণ্য আমদানির বিপরীতে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়। এতে আমদানি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে এলসি মার্জিন বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ করা হয়। পরে শতভাগ মার্জিন আরোপ করা হয়। একই সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে। এতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে এলেও শতভাগ মার্জিনেও অনেকে এলসি খুলতে থাকেন। পরে ওইসব এলসির দায় শোধের সময় ডলার পাওয়া না যাওয়ায় দেশের সুনাম রক্ষার্থে রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে দেনা শোধ করা হয়। এতে করে রিজার্ভ কমতে তাকে। ২০২২ সালের শেষদিকে নগদ ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে যারা ডলারের জোগান দিতে পারছে কেবল তাদেরই এলসি খোলা হতো। ওই সময়ে বিশেষ করে রপ্তানিকারকরাই এলসি খুলতে পারতেন। তাদের ডলার আয় ছিল। ওই ডলার দিয়ে নিজেদের রপ্তানি শিল্পের কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করতেন। এর বাইরে সরকারি ও অত্যাবশ্যকীয় কিছু পণ্য আমদানিতে রেমিট্যান্স থেকে ডলারের জোগান দেওয়া হতো। এর বাইরে বিশেষ করে বাণিজ্যিক ও ছোট আমদানিকারকরা এলসি খুলতে পারছিলেন না। ফলে আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ কমে গিয়ে দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়ে উৎপাদন কম হয়েছে। শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমে নতুন শিল্প স্থাপন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাবে বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ কমেছে। ফলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতিতে এখন যে সংকট তা বৈশ্বিক কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে। সংকট আগে থেকেই ছিল। সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। এখন ডলার প্রবাহ বাড়াতে পারলে সংকট মোকাবিলা করা অনেক সহজ হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ডলার সংকট মোকাবিলায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা স্থায়ী সমাধান নয়। এটি সাময়িক হতে পারে। কিন্তু প্রায় পৌনে দুই বছর ধরে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এতে আমদানিনির্ভর শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে। এতে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, করোনার পর অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধার হচ্ছিল তখন আমদানিও বাড়ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি খোলা বেড়েছিল ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছিল ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বৈশ্বিকভাবে সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। ওই বছরে এলসি খোলা বেড়েছিল ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এপ্রিল থেকে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে মে থেকে আমদানি কমে। ডলার সংকট ও নিয়ন্ত্রণের ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানির এলসি খোলা কমে যায় ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং আমদানি রেকর্ড পরিমাণে ৯২ দশমিক ৬৬ শতাংশ কমে যায়। এক বছরে আমদানি কমার এটাই ছিল রেকর্ড। ওই হারে আমদানি কমার পর এখনো কমানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে এলসি খোলা কমেছে ১৪ শতাংশ। আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ২৭ শতাংশ।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিদেশে পণ্যের দাম বেশি থাকার পরও সব খাতেই আমদানি কমেছে। এতে ডলারের হিসাবে যেমন আমদানি কমেছে, তেমনি পরিমাণেও কমেছে। গত অর্থবছরেও প্রায় খাতের পণ্যের আমদানি কমেছে। ওই কমার ওপর চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়েও কমেছে। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্যের এলসি সাড়ে ২৭ শতাংশ ও আমদানি ২২ শতাংশ কমেছে। সব ধরনের শিল্প উপকরণের আমদানি কমেছে। এর মধ্যে শিল্পের মৌলিক কাঁচামালের আমদানি কমেছে ৩৩ দশমিক ৬১ শতাংশ, এলসি খোলা কমেছে ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালের এলসি কমেছে ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, আমদানি কমেছে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। মৌলিক শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি কমেছে ১৭ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে শিল্পের ৩৬ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে ১১ শতাংশ। অন্যান্য পণ্যের আমদানি কমেছে ৩১ শতাংশ। গত অর্থবছরে ওইসব পণ্যের আমদানি আরও বেশি কমেছিল।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। গত অর্থবছরে এর কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে ২২ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৩৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে এলসি খোলা কমেছে ১ শতাংশ, আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশ। রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমায় এ খাতের উৎপাদনও কমছে। ফলে রপ্তানি আয়ও কমে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক অস্থিরতা ও দেশীয় সংকটে উদ্যোক্তাদের মধ্যেও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ডলার সংকটে এ অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে যায়। তারা বিনিয়োগ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এতে দেশি-বিদেশি পুঁজি যেমন বিনিয়োগ কম হয়েছে, তেমনি ঋণপ্রবাহও কমেছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সবচেয়ে বেশি কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ। গত অর্থবছরে বেড়েছে ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে বেড়েছে দেড় শতাংশ। এর মধ্যে আগের ঋণের সঙ্গে সুদ যোগ হয়ে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। নতুন ঋণ গেছে খুবই কম। বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে এসেছিল ৭৭ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৬৯ কোটি ডলার। এফডিআই কমেছে ৪ কোটি ডলার। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। আমদানির চাপে রিজার্ভ কমতে থাকে। এখন তা কমে ২ হাজার ৫২৭ কোটি ডলারে নেমেছে। আলোচ্য সময়ে রিজার্ভ কমেছে ২ হাজার ২৭৯ কোটি ডলার বা ৪৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। নিট রিজার্ভ আরও কম ২ হাজার ৩ কোটি ডলার। ডলারের দাম ধরে রাখার জন্য রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে। গত অর্থবছরেও ১ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিক্রি করেছে ৭৭৫ কোটি ডলার। ডলার সংকটের শুরুতে ২০২২ সালের এপ্রিলে এর দাম ছিল ৮৫ টাকা। এখন তা বেড়ে ১১০ টাকায় উঠেছে। এ হিসাবে টাকার মান কমেছে ৩০ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে ওই দরে ডলার মিলছে। গড়ে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২৬ টাকা করে। এ হিসাবে টাকার মান কমেছে ৪৮ শতাংশ।
পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও টাকার মান কমার কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। সংকটের শুরুতে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে সাড়ে ৯ শতাংশে ঠেকেছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশে উঠেছিল। এখন কিছুটা কমেছে। চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে বিশেষ করে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের ভোগান্তি অনেক বেড়েছে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।