ঢাকা ওয়াসায় এখনো তাকসিমের দোসরদের দাপট


বিগত প্রায় দেড় দশকে ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। এসব কারণে জনরোষে পদত্যাগ করেছেন ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। তবে তার দুর্নীতির শীর্ষ দোসররা এখনো বহালতবিয়তে থেকে দাপট দেখাচ্ছেন। সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেছেন এমন প্রচারণাও চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসাসংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, ৫ আগস্ট দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পালিয়ে যান প্রকৌশলী তাকসিম। সে সময় গা ঢাকা দেন তার সহযোগীরাও। ১৪ আগস্ট প্রকৌশলী তাকসিম পদত্যাগের পর তার সহযোগীরা ঢাকা ওয়াসার জাতীয়তাবাদী প্রকৌশল সমিতি এবং জাতীয়তাবাদী শ্রমিক সংগঠনের কয়েকজনকে ‘ম্যানেজ’ করেছেন। এরপর থেকে তারা নিয়মিত অফিস করছেন এবং বীরদর্পে সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা জানান, প্রকৌশলী তাকসিমের দোসররা দুর্নীতি, চাটুকারিতা ও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে সিংহভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপছন্দের পাত্র। তারা এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসার অনেক ক্ষতি করেছেন। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম সহিদ উদ্দিন ঢাকা ওয়াসার সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। ঢাকা ওয়াসায় তার ক্যারিয়ার দীর্ঘদিনের। তিনি ঢাকা ওয়াসার সব ভালো-মন্দ জানেন। তিনি প্রকৌশলী তাকসিমের সময়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বললেও সাবেক দুর্নীতিবাজ এমডির দোসরদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ও পদে বসিয়ে রেখে প্রশাসন পরিচালনা করছেন। এসব বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম সহিদ উদ্দিন বলেন, যারা আগে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হবে। আর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ঢাকা ওয়াসা সেবাধর্মী সংস্থা; নগরবাসীকে সর্বোচ্চ পানি ও পয়ঃসেবা দিতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এটা অব্যাহত থাকবে। ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বিগত সময়ে ঢাকা ওয়াসায় প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ঘনিষ্ঠজন ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সহযোগী হিসাবে কাজ করেছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি ঢাকা ওয়াসার প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। এই প্রকল্প থেকে তার নেতৃত্বে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। এ প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করলেও প্রভাবশালী মহলের চাপে তা থামিয়ে দেওয়া হয়। ওই প্রকৌশলী বর্তমানে ‘ঢাকা স্যানিটেশন ইমপ্রুভমেন্ট’ নামের মেগা প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন। এই প্রকল্পেও তিনি বড় অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবুও তাকে স্বপদে বহাল রাখা হয়েছে। সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার বিরুদ্ধে তদন্ত ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। প্রকৌশলী তাকসিমের অনিয়ম ও দুর্নীতির দোসরদের তালিকায় আরও রয়েছেন-ঢাকা ওয়াসার ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক এবং সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. ওয়াজ উদ্দিন। ঢাকা ওয়াসার এমডির স্টাফ অফিসার এবং ঢাকা ওয়াসার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদরুল আলম এবং ঢাকা ওয়াসার সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প, ফেজ-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান। এছাড়া দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নেটওয়ার্ক তৈরি প্রকল্পের পরিচালকের পাশাপাশি প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন প্রকৌশলী মোস্তফা কামাল মজুমদার এবং ঢাকা ওয়াসার নির্বাহীর দায়িত্বের পাশাপাশি সংস্থার সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন প্রকৌশলী শারমিন হক আমির। প্রকৌশলী হওয়া সত্ত্বেও সংস্থার ভিন্ন ধরনের দুটি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন তারা দুজন। ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডির দুর্নীতি ও অনিয়মের সহযোগী হওয়ায় তাদের সেসব পদে বহাল রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে সংস্থায় অসন্তোষ বাড়ছে। উপরোল্লিখিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তারা সবাই গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন। ঢাকা ওয়াসার জনতথ্য বিভাগের সহযোগিতা চেয়েও তাদের মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি। ঢাকা ওয়াসা সূত্রে আরও জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার জোন পর্যায়েও সাবেক এমডির ঘনিষ্ঠজন ও দোসররা বহালতবিয়তে রয়েছেন। আগে আওয়ামী লীগ পরিচয়ে বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সুপারিশ এনে দায়িত্ব নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে সহযোগিতা করেছেন। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এখন তারা আবার বিএনপি বনে গিয়ে দাপট দেখাচ্ছেন। তাদের এসব কাজে সহযোগিতা করছেন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। তারা ওইসব লোকদের কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা গ্রহণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার জাতীয়তাবাদী প্রকৌশলী সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আলমগীর হাছিন আহমেদ বলেন, অনেক বছর ধরে দপ্তরবিহীন হিসাবে রয়েছি। এখনো পর্যন্ত দপ্তর পাইনি। আগের মতো ঢাকা ওয়াসা ভবনের নিচে গিয়ে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে যাই। এজন্য ঢাকা ওয়াসা ভবনে কারা কী করছে, তা আমি জানি না। একই বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা জাতীয়তাবাদী এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি আজিজুল আলম খান এবং সাধারণ সম্পাদক মো. মনির পাটোয়ারীর ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম আহমেদ খানের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালত ৬০ দিনের জন্য তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে প্রথমবারের মতো নিয়োগ পেয়েছিলেন তাকসিম এ খান। এরপর দফায় দফায় তার মেয়াদ বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে সপ্তমবারের মতো ওই পদে আরও ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা অভিযোগ থাকার পরও তাকসিমকে একই পদে দীর্ঘ সময় রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠে। সম্প্রতি তিনি বাধ্য হয়ে এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করেন।