দলীয় নির্দেশনার তোয়াক্কা করছেন না মন্ত্রী-এমপি
অনলাইন নিউজ ডেক্স
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য (এমপি) ও মন্ত্রীদের ‘হস্তক্ষেপ’ ঠেকাতে কড়া ভাষায় সতর্ক করেছে আওয়ামী লীগ। তবে নিজেদের ক্ষমতার বলয় ধরে রাখতে মরিয়া স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা। ফলে কেন্দ্রের (আওয়ামী লীগ) কোনো নির্দেশনারই তোয়াক্কা করছেন না তারা। নানা কৌশলে পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। এছাড়া প্রার্থিতা প্রত্যাহারে চাপ প্রয়োগ, প্রচারণা ও মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া, প্রার্থীকে অপহরণসহ নানা অভিযোগ উঠছে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি উপজেলায় ঘটেছে সংঘাতের ঘটনাও। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, দলের অভ্যন্তরে সংঘাত-সহিংসতা, হামলা-পালটা হামলা ও বিশৃঙ্খলা বাড়ার শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চান। ফলে নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীসহ কারোর বিরুদ্ধে প্রভাব সৃষ্টির অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীরা যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়ে একাধিকবার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় প্রধানের এমন নির্দেশনার বিষয়ে মঙ্গলবার দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে হয়, মন্ত্রী-এমপিরা যেন প্রভাব বিস্তার না করে, প্রশাসন যেন কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করে-সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। নির্বাচনে কারও হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, উপজেলা নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যেই তৃণমূলে উৎসব শুরু হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের নিজের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে আমাদের দলের তৃণমূল পর্যায়ের কিছু প্রভাবশালী নেতা এবং সংসদ সদস্য সরাসরি প্রার্থীদের পক্ষ নিয়েছে। তারা দলীয় নির্দেশনা মানছে না। এদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে-এটা শতভাগ নিশ্চিত। দলীয় নেতাকর্মীসহ সবাই এ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন, নির্বাচন করতে পারবেন। যিনি বেশি জনপ্রিয়, তিনিই নির্বাচিত হবেন। নৌকার প্রার্থী না দিয়ে সেই সুযোগ আওয়ামী লীগ করে দিয়েছে। কিন্তু দলের ব্যানার ব্যবহার করে কেউ পক্ষ নেবে, নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করবে, দলের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে, দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে বিভক্তি তৈরি করবে-সেই সুযোগ দেওয়া হবে না। কারও বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টির অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্ত।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে কেউ প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা করছে কি না-সে বিষয়ে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এমপি-মন্ত্রী বা দলের প্রভাবশালী কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, আগামী ৮ মে ১৫০ উপজেলায় ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে সারা দেশে শুরু হবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই তৃণমূল পর্যায়ে শুরু হয়েছে নির্বাচনি আমেজ। ভোটারের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ফের মুখোমুখি অবস্থানে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দিলেও নির্বাচন স্থানীয় এমপিদের প্রভাবমুক্ত রাখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে নানা অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করায় একাধিক এমপির বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগ দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা।
মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মাদারীপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী শফিক খান বলেন, নির্বাচনে এমপির ছেলে প্রার্থী হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। তারা ভয় পাচ্ছে শেষ পর্যন্ত এমপি পেশিশক্তির প্রভাব দেখিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করবেন। এমপির ভয়ে তার বিরুদ্ধে অনেকে প্রকাশ্যে কাজ করছে না। তারাও হামলা-মামলা ও নির্যাতনের ভয় পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, একজন এমপির অনেক ক্ষমতা। অর্থনৈতিকভাবে এমপিরা এগিয়ে থাকে। সব মিলে নির্বাচনে কী পরিবেশ হবে-বলা সত্যিই কঠিন। তবে এমপিরা যেন কোনোভাবেই নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে-সে বিষয়ে দলের কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।
উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্য দীর্ঘদিন প্রচার-প্রচারণা করলেও শেষ পর্যন্ত নিজের মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারেননি মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বর্তমানে ‘এমপি লীগ’র হাতে বন্দি। এমপি ক্ষমতাবলে পরিবারতন্ত্র সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমি চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলাম, কিন্তু আমাকে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেওয়া হয়নি। এমপি আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। শুধু আমি নই, এমপি পরিবারতন্ত্রের কাছে দলের ত্যাগীরা সবাই চাপের মধ্যে পড়েছে।
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসান রনি বলেন, আমাদের এমপি কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না। তিনি সরাসরি প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচনের আগেই বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটবে। নেতাকর্মী খুনের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নেই। দল সবাইকে নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছেন। সেখানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে থেকে একজন এমপি কীভাবে একজন প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান? তার এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
উপজেলা নির্বাচনে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের ক্ষমতার অব্যবহার, প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা ও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতা নিয়ে ক্ষুব্ধ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও। তাদের মতে, দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচন হবে। নির্বাচনে কারও পক্ষ নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে কেউ সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়লে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানতে চাইলে নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বলেন, উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের অবশ্যই সাংগঠনিক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জহুরুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকায় সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। দলীয় প্রতীক থাকলে এই ধরনের ঘটনা ঘটত না। তবে আমরা বিশ্বাস করি, শঙ্কা থাকলেও প্রতীক বরাদ্দের পর এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে মঙ্গলবার টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে জেলার মধুপুর উপজেলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় দশজন আহত হন। এ সময় বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।
এর আগে চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণ ঘটনা ঘটে নাটোরের সিংড়া উপজেলায়। দেলোয়ার হোসেন নামে ওই প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে এক প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লুৎফুল হাবীবের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে পুরো জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের সংঘাত-সহিংসতার ঘটনাও ঘটতে পারে বলে শঙ্কা করছেন অনেকেই।
নির্বাচন নিয়ে কুমিল্লার মেঘনা এবং নাঙ্গলকোটে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে চলছে নানা কোন্দল। এ দুটি উপজেলায়ই আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করায় নেতাকর্মীদের মাঝে গ্রুপিং ও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।