দুদকের নজরে অর্ধশতাধিক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা


ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ও অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন অব রশীদের (ডিবি প্রধান) অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে হারুন ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এছাড়া পুলিশের অর্ধশতাধিক ‘দুর্নীতিবাজ’ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছেন দুদকের নজরে। সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিট এই কর্মকর্তাদের তালিকা চূড়ান্ত করেছে। পুলিশের উচ্চাভিলাষী অপেশাদার এসব কর্মকর্তা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তালিকায় সাবেক একাধিক আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনারের নাম রয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থে পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ধ্বংসের জন্য এসব কর্মকর্তা অপকর্মে জড়িয়েছে বলে দুদক গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ চাকরিকালে অবৈধ পথে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এই দুই কর্মকর্তা নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যা তাদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই দুই পুলিশ কর্তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও আছে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধান করতে টিম গঠন করেছে দুদক। এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার ও গোয়েন্দা শাখার প্রধান হারুন অব রশীদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধান টিমও গঠন করা হয়েছে। টিমের সদস্যরা তাদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবেন। জানা গেছে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অব রশীদ চরম বিতর্কিত একজন কর্মকর্তা। তিনি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের পুলিশ সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেন। নারায়ণগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালে সেখানকার প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গেও তার ‘দা-কুমড়া’ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হয়েও তিনি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের ঢাকার বাসায় অভিযান চালিয়ে নারী সদস্যসহ কয়েকজনকে তুলে নিয়ে যান। বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। এছাড়া গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালেও তিনি ব্যবসায়ীদের তুলে নিয়ে টাকা আদায় করেন। সবশেষ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ওয়ারীতে কয়েকশ কোটি টাকার জায়গা দখলের জন্য জায়গার মালিক ও পরিবারের সদস্যদের ধরে জেলহাজতে পাঠান। এভাবে অবৈধ পথে তিনি শত শত কোটি টাকা আয় করে বিদেশে পাচার করেন। বনানী ও উত্তরায় তার একাধিক বাড়ি থাকার তথ্যও আছে দুদকের কাছে। আমেরিকার পাসপোর্টধারী হারুন ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই পলাতক। এ অবস্থায় দুদক তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিল। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, দুদকের কাছে হারুনের অবৈধ সম্পদের অভিযোগ আরও অনেক আগেই জমা ছিল। অভিযোগ অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছিল যাচাই-বাছাই কমিটি। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে ফাইলটি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল দুদক। এ থেকে প্রমাণ হয় দুদক এতদিন সরকারের আজ্ঞাবহ হয়েই কাজ করেছে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের ফিরিস্তি বেশ কিছুদিন ধরেই গণমাধ্যমে প্রচার-প্রকাশ হচ্ছিল। যদিও আছাদুজ্জামান মিয়া বারবার গণমাধ্যমে দাবি করেছেন তার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। যেসব সম্পদের কথা বলা হয়েছে সবই তার বৈধ সম্পদ। আয়কর ফাইলেও এসব সম্পদ দেখানো আছে। দুদকের অনুসন্ধান টিম এই দুই কর্মকর্তার দুর্নীতি ও সম্পদের অনুসন্ধান করে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে জানা গেছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, শুধু এরা নয়-দুদকের নজরে আছেন অর্ধশতাধিক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। যারা গত ১৬ বছরে উচ্চাভিলাষী অপেশাদার আচরণের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সদ্যবিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ নিয়ে তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ করেছেন বলেও প্রমাণ রয়েছে। এদের অনেকেই ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করেছে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট। তালিকায় থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার ও গ্রেফতার বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। দুদকের নজরে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন-সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। তিনি আইজিপি হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর দুই দফায় চুক্তিভিত্তিক আইজিপি হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুদকের নজরে আরও আছেন-সাবেক আইজিপি শহীদুল হকসহ কয়েকজন। এছাড়া ডিএমপির সাবেক কমিশনার খন্দাকর ফারুক হোসেন ও মো. শফিকুল ইসলামও আছেন দুদকের নজরে। অতিরিক্ত আইজি আতিকুল ইসলাম, পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের নামও রয়েছে। অতিরিক্ত আইজি ওয়াইএম বেলালুর রহমান, শিল্পপুলিশের প্রধান মাহবুবুর রহমান, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সিআইডির সদস্য ওএসডি হওয়া প্রধান অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, অতিরিক্ত আইজি দেবদাস ভট্টাচার্য, খন্দকার লুৎফুল কবীর, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ও ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মীর রেজাউল আলম। ডিএমপির ওএসডি হওয়া কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি অপারেশন আনোয়ার হোসেন, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার, ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, রংপুর রেঞ্জের অব্যাহতি পাওয়া ডিআইজি আবদুল বাতেন, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ও সিআইডির শেখ নাজমুল আলম, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার ইমাম হোসেন (বর্তমানে সিআইডিতে কর্মরত), গাজীপুর মেট্রোপলিটন কমিশনার মো. মাহবুব আলম, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার ও চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মো. মনিরুজ্জামান, পুলিশ সদর দপ্তরের জয়দেব কুমার ভদ্র ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। এছাড়া আছেন-শাহ মিজান শফিউর রহমান, মো. আনিসুর রহমান, মোল্যা নজরুল ইসলাম, এসএম মোস্তাক আহমেদ, জিহাদুল কবীর, মো. ইলিয়াস শরীফ, নূরে আলম মিনা, শাহ আবিদ হোসেন, মো. জামিল হাসান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম, রাজশাহী রেঞ্জের বিপ্লব বিজয় তালুকদার, এসবির মোহা. মনিরুজ্জামান, শ্যামল কুমার নাথ, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. আলমগীর কবির, মো. হামিদুল আলম, ড. শামসুন্নাহার, ড. একেএম ইকবাল হোসেন ও মো. মাসরুকুর রহমান খালেদ। আরও আছেন-ডিএমপির যুগ্ম আলোচিত কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মো. মারুফ হোসেন সরদার, বিজয় বসাক ও সুব্রত কুমার হালদার, শ্যামল কুমার মুখার্জি, মো. সাজ্জাদুর রহমান, প্রবীর কুমার রায়, আসম মাহতাব উদ্দিন, মোহা. আহমারুজ্জামান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, মো. মোকতার হোসেন, পংকজ চন্দ্র রায়, খন্দকার নূরুন্নবী, এসএম মেহেদী হাসান, মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান, ডিবি উপকমিশনার মশিউর রহমান (সদস্য সিএমপিতে বদলি), মো. শহিদুল্লাহ, সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ ও মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, আসমা সিদ্দীকা মিলি, হায়াতুল ইসলাম খান, জসিম উদ্দিন মোল্লা, মোহাম্মদ মইনুল হাসান ও মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, ২৫ ব্যাচের ঢাকার এসপি মো. আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল, পাবনার এসপি মো. আব্দুল আহাদ, রাজিব আল মাসুদ ও মো. শাহজাহানসহ কয়েকজনের নাম রয়েছে।