দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প, আমেরিকায় অভিবাসন ও শুল্কে বৈরী নীতির মুখে পড়তে পারে মোদির ভারত


ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, তিনি আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন আনতে চান, যেখানে ‘সবার আগে আমেরিকা’ নীতি বা আমেরিকার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সম্প্রতি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণম জয়শঙ্কর বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যিনিই জেতেন না কেন, দেশটি হয়তো আরও বেশি করে ‘একলা চলো’ নীতি গ্রহণ করতে পারে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ‘হ্যালো মোদি’ ও ‘নমস্তে ট্রাম্প’—এর মতো হাই প্রোফাইল অনুষ্ঠানে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সময়। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের একটি মূল দিক ছিল এই বিষয়গুলো। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হলেও ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ নয়া দিল্লির জন্য বেশ কিছু সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে, বাণিজ্য, অভিবাসন, সামরিক সহযোগিতা এবং কূটনীতি—এই চারটি ক্ষেত্রে। ট্রাম্প ও মোদি পরস্পরকে একাধিকবার বন্ধু বলে সম্বোধন করলেও সামগ্রিকভাবে ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে ভারত বেশ চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়তে পারে। সর্বশেষ, ডোনাল্ড ট্রাম্প আনুষ্ঠিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘অন্তরের অন্তস্তল থেকে অভিনন্দন’ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে শেয়ার করা এক টুইটে বলেছেন, ‘আসুন, একসঙ্গে আমাদের জনগণের জন্য কাজ করি এবং বিশ্বশান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিই।’ ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিকে সহজভাবে উপস্থাপন করা হলে বলা যায়, এটি আমেরিকার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিতে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা কমায়। প্রথম মেয়াদে, ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং ইরানের পরমাণু চুক্তি সহ গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো থেকে বেরিয়ে আসেন বা বিষয়বস্তু পরিবর্তন করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হলে, এ ধরনের নীতি অব্যাহত থাকলে ভারতসহ ঐতিহ্যগত মার্কিন মিত্র সম্পর্ক ও চুক্তিগুলোতে আবারও প্রভাব পড়তে পারে। ট্রাম্পের নতুন প্রশাসন ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে। গত মাসে ট্রাম্প অভিযোগ করেন, ভারত বিদেশি পণ্য আমদানিকে সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপ করে থাকে এবং তিনি বলেন, নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ভারতীয় পণ্যেও ‘রেসিপ্রোকাল ট্যাক্স’ (পারস্পরিক সমানুপাতিক কর) চালু করা হবে। ট্রাম্প বলেন, ‘আমার পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, আমেরিকাকে অত্যন্ত ধনী করে তোলা এবং এর মূল কথা হচ্ছে সমান-সমান আচরণ। আমরা সাধারণত শুল্ক আদায় করি না। আমি সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছি। চীন আমাদের পণ্যে ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, ব্রাজিল বড় ধরনের শুল্ক আরোপকারী, আর সব থেকে বড় শুল্কারোপকারী হলো ভারত।’ তিনি বলেন, ‘ভারত খুব বড় ধরনের শুল্ক আরোপকারী দেশ। আমাদের ভারতের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে দেশটির নেতা মোদির সঙ্গে, তিনি একজন মহান নেতা। সত্যিই তিনি একজন মহান ব্যক্তি। তিনি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, চমৎকার কাজ করছেন। কিন্তু তারাও বেশ বড় শুল্ক আদায় করে।’ ট্রাম্পের সম্ভাব্য এই শুল্কনীতি ভারতের আইটি, ওষুধ এবং টেক্সটাইল খাতে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ এই খাতগুলো মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরশীল। অপরদিকে, চীন থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য ট্রাম্পের যে নীতি, তা ভারতের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে। মার্কিন কোম্পানিগুলো যেহেতু তাদের সরবরাহ চেইন চীন থেকে সরিয়ে আনতে চায়, এর ফলে ভারত নিজেকে একটি উৎপাদন হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পেতে পারে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের কড়া অভিবাসন নীতিমালা, বিশেষ করে এইচ-১বি ভিসা নীতি ভারতীয় পেশাজীবীদের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। তাঁর প্রথম শাসনামলে বিদেশি কর্মীদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং বাড়তি নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা করেছিলেন। যা ভারতীয় আইটি পেশাজীবী এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। ট্রাম্পের নতুন প্রশাসন যদি আবার এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং সেসব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রভাবিত করবে, যেগুলো ভারতীয় কর্মীদের ওপর নির্ভরশীল। এই বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘ট্রাম্পের সঙ্গে (ভারতের) বাণিজ্য এবং অভিবাসন নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বেশ কঠিন দেনদরবার করতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে অন্যান্য অনেক বিষয়ে তিনি ভারত এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কের কথা বলেছেন।’ ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। জো বাইডেন প্রশাসনের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোগ এবং জেট ইঞ্জিন তৈরির জন্য জিই-হালের মতো প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলো ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের প্রধান দিকগুলোর মধ্যে ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটো সম্পর্কে সাবধানী মনোভাব দেখিয়েছেন এবং পুনরায় ক্ষমতায় এলে তিনি সামরিক জোটগুলোর ক্ষেত্রে একই ধরনের অবস্থান নিতে পারেন। তবে, চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অব্যাহত থাকতে পারে।