নিয়োগ বাণিজ্যের বাধা ছিলেন ডা. মনোয়ারুল?


পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে নিয়োগ বাণিজ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় ডা. মনোয়ারুল হককে হত্যা করা হয় বলে দাবি করেছেন স্বজনরা। তাঁরা বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনৈতিক আবদার রক্ষা না করায় তাঁকে শায়েস্তা করতে ফন্দি আঁটা হয়। কৌশলে তাঁর কার্যালয় থেকে ফাইল সরিয়ে বেকায়দায় ফেলা হয়। পরে হিসাব দিতে না পারায় ওঠে অডিট আপত্তি। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে চাইলেও বিরুদ্ধে থাকা কর্মকর্তারা সব জটিল করে তুলছিলেন। সর্বশেষ সোমবার তিনি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন সচিব। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গোপন স্থানে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করা হয়। অবশ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) খান মো. রেজাউল করিম বলেন, মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১১ এপ্রিলের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। তখন এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে ২ কোটি ৪১ লাখ টাকার পাঁচটি অডিট আপত্তি রয়েছে। এখনও তা নিষ্পত্তি হয়নি। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে মনোয়ারুল হকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি নরসিংদীর রায়পুরায় উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়েছে। মৃতের ভাই সাবেক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা মনিরুল হক বলেন, মনোয়ারুল হকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন নরসিংদী জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক অরবিন্দ দত্ত। তিনি নিম্নপদস্থ কিছু কর্মচারীর নিয়োগের ব্যাপারে সুপারিশ পাঠাতে বলেছিলেন। তবে যাঁদের জন্য সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল, তাঁরা উপযুক্ত না হওয়ায় মনোয়ারুল রাজি হননি। তখন তাঁকে বলা হয়, নিয়োগের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ পাওয়া যাবে। তাঁকেও এর ভাগ দেওয়া হবে। আর সুপারিশ না করলে ফল ভালো হবে না। পরে তিনি বাধ্য হয়ে সেই ব্যক্তিদের নিয়োগে সুপারিশ করেন। তবে কৌশলে উল্লেখ করেন যে, তাঁরা নিয়োগ পাওয়ার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হননি। ফলে এই ফাইল পরে উচ্চ পর্যায় থেকে ফেরত আসে। সেসঙ্গে উপপরিচালককে তিরস্কারের মুখে পড়তে হয়। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হন। পরে ২০২০ সালে করোনাকালে ‘হোম অফিস’ চলছিল। সে সময় তিনি নিজস্ব লোক দিয়ে রায়পুরা কার্যালয় থেকে কিছু ফাইল বের করে অন্যত্র নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। ২০২১ সালে সে ফাইলগুলো নিরীক্ষা করতে চান উপপরিচালক। সংগত কারণেই সেগুলো পাওয়া যায়নি। পরে ফাইলে থাকা হিসাব ঠিকঠাক দিতে না পারায় মনোয়ারুলের বিরুদ্ধে এক কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়। ফাইল না পাওয়া গেলেও তদন্তে দেখা যায়, যেসব কর্মচারীর বেতন-ভাতার হিসাব সেখানে ছিল, তারা ঠিকঠাক সেই টাকা পেয়েছেন। তবে ফাইল হারানোকে গাফিলতি হিসেবে বিবেচনা করে তাঁর এক বছরের ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়। মনিরুল জানান, এসব ঘটনার পর ওই উপপরিচালকের অধীনে কাজ করবেন না উল্লেখ করে ২০২২ সালের শুরু থেকে স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন মনোয়ারুল। ফাইল অগ্রগামী হতে হলে উপপরিচালকের স্বাক্ষর লাগে। তিনি স্বাক্ষর না করায় প্রক্রিয়া ঝুলে থাকে। পরে পুরোনো অডিট আপত্তির সঙ্গে নতুন করে আরও কিছু টাকার হিসাবের গরমিলের নথি তৈরি করে অবসর আবেদনের ফাইলের সঙ্গে জুড়ে অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। এর মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু আগের বিষয়টি ঝুলে থাকায় তাঁর বেতন আটকে ছিল। আবার অবসরের আদেশ জারি না হওয়ায় পেনশনও চালু হয়নি। গত সোমবার তিনি এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে মন্ত্রণালয়ে যান। তখন সচিব সব শুনে তাঁর ফাইল এনে দেখেন, নিষ্পত্তি হওয়া পুরোনো অডিট আপত্তি আবারও পেশ করা হয়েছে। তাই তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলেন যে, কেন এই আপত্তি অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। পর দিন মঙ্গলবার এ প্রক্রিয়ার হালনাগাদ তথ্য পেতে অধিদপ্তরে যান মনোয়ারুল। এ বিষয়ে নরসিংদী জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক অরবিন্দ দত্ত বলেন, কর্মচারী নিয়োগের জন্য মনোয়ারুল হককে কোনো সুপারিশ করতে বলা হয়নি। কারণ এ জন্য তাঁর সুপারিশের প্রয়োজনই নেই। আর তাঁর অফিসের কিছু ফাইল পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁর ভাষ্য ছিল, অফিস স্থানান্তরের সময় সেগুলো হারিয়ে যায়। ফাইল সরিয়ে ফেলার অভিযোগ অবান্তর। এদিকে নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলেন মৃতের স্বজনরা। মঙ্গলবার তাঁর কক্ষেই পাওয়া যায় মনোয়ারুলের লাশ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পারিবারিক সমস্যা ও হতাশার কারণে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে আমার মনে হয়। স্বজনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। তদন্ত শেষে তারাই বিস্তারিত জানাবে। তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ আলম বলেন, ঘটনাস্থল বা আশপাশে কোনো সচল সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।