নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন ও বিক্রি ওপেন সিক্রেট


এ যেন পলিথিনের শহর, পলিথিনের দেশ। শহর-বন্দর-গ্রামে, হাটে-বাজারে, টিনের ঘর থেকে দালানে, হাতে হাতে শুধু পলিথিন আর পলিথিন। পরিবেশ, জনজীবন, জলাধার, ভূমি, নদী, সমুদ্র, প্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ এই পলিথিন নিষিদ্ধ হলেও এর উৎপাদন, বিপণন এবং বিক্রি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। প্রশাসনের নাকের ডগায় পলিথিন এবং নিম্নমানের প্লাস্টিক পণ্য দেদার বিক্রি, ব্যবহার এবং ফেলে দেওয়া হলেও কারোরই যেন কিছু করার নেই। অপচনশীল পলিথিনের বিকল্প পণ্য বাজারে থাকলেও সেগুলো ব্যবহার সামান্য। এসব বিকল্প পণ্য ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগও নেই। তাই সহজলভ্য পলিথিনের যথেচ্ছ এবং নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে সারা দেশ পলিথিন এবং নিম্নমানের প্লাস্টিকে সয়লাব। পলিথিনে ভরে গেছে দেশের নদী-সাগরের তলদেশ। সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর তলিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এই পলিথিন এবং প্লাস্টিক বোতল। ভেঙে পড়ছে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। পলিথিন ও প্লাস্টিক পরিবেশ দূষণ ত্বরান্বিত করছে। নিম্নমানের পলিথিন ব্যাগ, কেন্ডির মোড়ক, বিস্কিটের প্যাকেট ও চিপসের প্যাকেট, প্যাকেট শ্যাম্পু, বিভিন্ন ধরনের জুসের প্যাকেট ও বোতল, পানি ও কোমল পানির বোতলে সয়লাব দেশের খাল-বিল, পুকুর, ডোবা, নদ-নদী, এমনকি সাগরও। গবেষকরা বলছেন, সাগরের তলদেশে যে পরিমাণ পলিথিন জমেছে তা একটি মহাদেশের সমান হবে। এমনকি তারা আরও সতর্ক করে বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে নদ-নদীতে মাছ আর পাওয়া যাবে না। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর বিধান অনুসারে দেশে ২০০২ সাল থেকে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন এবং পরিবহণ নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তী একটা সময়ে পলিথিনের ব্যবহার অনেকটাই কমে আসে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের নতুন উদ্যমে পলিথিনকে ফিরিয়ে আনা এবং প্রশাসনের সঠিক তদারকির অভাবে দেশে এখন পলিথিন এবং প্লাস্টিক পণ্য সবখানে। আইনের কার্যকর কোনো প্রয়োগ নেই। ফলে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি পরিবারে চারটি করে ধরলেও ঢাকায় প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। রাজধানীর লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও লালবাগের চান্দিরঘাট পুরো এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় অননুমোদিত প্লাস্টিক উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। ওই এলাকায় প্রকাশ্যে ৯ শতাধিক অবৈধ পলিথিনের উৎপাদন কারখানা রয়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান। পলিথিন এবং নিম্নমানের প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতের অন্যতম স্থান রাজধানীর লালবাগসংলগ্ন কামালবাগ ও কামরাঙ্গীরচর। মূলত প্লাস্টিক এবং পলিথিন পণ্য উৎপাদনকারী এসব কারখানা জেগে ওঠে সন্ধ্যা থেকে। রোববার সন্ধ্যায় কামালবাগে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মহোৎসবে সেখানে ফেলে দেওয়া পলিথিন গলিয়ে এবং প্রক্রিয়াজাত করে নতুন পলিথিন ও নিম্নমানের প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। ছোট-বড় কাঁচা দেওয়ালের ঘরগুলোতে একধারে এ কাজ করছেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। পুরো কামালবাগ এবং কামরাঙ্গীরচরজুড়েই এ রকম কারখানা। কাজ চালিয়ে গেলেও শ্রমিকদের তটস্থ থাকতে দেখা যায়। সেখানকার পলিথিন প্রস্তুত কারখানার কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা কথা বলতে রাজি হয়নি। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কামালবাগের ডাইস ব্যবসায়ী সুমন বলেন, পুরো কামালবাগ ও কামরাঙ্গীরচরসহ আশপাশের অনেক জায়গায় পলিথিন এবং নিম্নমানের প্লাস্টিকের পণ্য প্রস্তুত হয় প্রতিদিনই। সারা দেশের পলিথিন মূলত এখানেই উৎপাদন হয়। তিনি বলেন, পলিথিন উৎপাদন নিষিদ্ধ বলে অনেক জায়গায় খুব ছোট-ছোট ঘরে দরজা লাগিয়ে চলতে থাকে পলিথিনের উৎপাদন। কামালবাগ থেকে চুড়িহাট্টা এবং বেগমবাজারে এসে সরেজমিন দেখা যায়, এখানে প্রশাসনের নাকের ডগাতেই বিক্রি হচ্ছে পলিথিন এবং নিম্নমানের প্লাস্টিক পণ্য। এক দোকানিকে বাজারে ব্যবহার হওয়া পলিথিনের দাম জিজ্ঞেস করতেই বলেন, পলিথিনের কেজি ১৫০ টাকা। ১ কেজিতে ১২০টা বড় পলিথিন হয়। বিভিন্ন সাইজের আছে। এ সময় একই স্থানে টহল পুলিশের অবস্থানও দেখা যায়। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে পলিথিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সিটি করপোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা সদরে। ফলে শহরসংলগ্ন নদ-নদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে বেশি। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বরিশালের কীর্তনখোলা, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরুস্তর পড়েছে। এসব নদীর তলদেশে কয়েক ফুট পুরু পলিথিনের আস্তরণ জমার কারণে নদীর দূষণ তো বটেই, জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিনের প্রভাবে নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে, নদীভাঙন বাড়ছে। নদীতে মাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। বহু প্রজাতির মাছ ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্র জলাবদ্ধতা মারাত্মক সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। শহর, গ্রামের পয়ঃনিষ্কাশনে ব্যবহৃত ড্রেন ময়লায় বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ময়লার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশজুড়ে রয়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতল। ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ ড্রেন পলিথিনে আবদ্ধ। জলাবদ্ধতায় অনেক সময় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। তবু নাগরিক সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন, পলিথিন মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে ফসলের ক্ষতি করছে। জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার নিজ দপ্তরে বলেন, এই মন্ত্রণালয়ের সব কাজ মানুষকে করতে হয়। আমাদের কাজ সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আমরা তাই করার চেষ্টা করছি। আমরা মানুষকে পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তারা না শুনলে আমরা কী করতে পারি। মানুষের কাজগুলো তো আর আমরা গিয়ে করে দিতে পারি না। দেশের মানুষ যদি তাদের ভালো না বুঝতে চায় তাদের কীভাবে তা বোঝানো যাবে। তিনি আরও বলেন, মানুষ সচেতন হলে পরিবেশ দূষণের কোনো সুযোগই থাকবে না। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ এককভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ নয়। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান করবে আর নাগরিকরা পলিথিন ব্যবহার করতেই থাকবে। এ ধারণা ঠিক নয়। সব অংশীজনকে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে যা সফল বাস্তবায়নে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার কমে আসবে। যারা পলিথিন ও প্লাস্টিক উৎপাদন করে তাদের বিকল্প পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত করার জন্য কাজ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তর ডিজিটাল ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মহাসচিব শরীফ জামিল বলেন, পুরো পৃথিবী থেকে পলিথিন ও প্লাস্টিক বাতিল করা হচ্ছে বা করছে। বিশ্বের প্রথম ১০টি পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সমুদ্রের তলদেশ পলিথিন-প্লাস্টিকে ভরে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছর পর সমুদ্রে মাছের চেয়ে পলিথিন বেশি থাকবে। একটি পলিথিন মাটিতে পুঁতে রাখলেও নষ্ট হতে সময় লাগে প্রায় ৪শ বছর। এক কথায় পলিথিন ও প্লাস্টিক আমাদের সামগ্রিক জীবন খেয়ে ফেলছে। তিনি আরও বলেন, সরকার পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন, বহন, পরিবহণ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বিকল্প কী ব্যবহার করতে হবে তার গাইডলাইন দেয়নি। ফলে আইন কাগজে-কলমে। সব অংশীজনকে নিয়ে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ বলেন, সমুদ্রের তলদেশে যে পরিমাণ পলিথিন ও প্লাস্টিক জমেছে তাতে মনে হচ্ছে আরেকটি মহাদেশের সমান হবে। আগামী দিনে সমুদ্র ভরাট হয়ে যাবে। নদ-নদী ও সমুদ্রে কোনো মাছ পাওয়া যাবে না। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। সহজে মাটিতে মিশে যায় এমন দ্রব্য উৎপাদন করতে হবে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাটের ব্যাগ সহজলভ্য করতে হবে। যে কাপড়ে সিনথেটিক বেশি সে ধরনের কাপড় উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যে পরিমাণ প্লাস্টিক সাগরের নিচে জমা আছে, তা কয়েকশ বছরেও শেষ হবে না। আর এই প্লাস্টিক মানুষের দেহে বিভিন্ন আকারে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন করছে।