নেতাকর্মীদের আদর্শিক ভিত নড়বড়ে, পথ হারাচ্ছে ছাত্র রাজনীতি


বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র রাজনীতি এখন কাঠগড়ায়। সংগঠনগুলোর একশ্রেণির নেতাকর্মীর অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্র রাজনীতিবিমুখ করছে। আদর্শিক ভিত নড়বড়ে থাকায় নতুন কর্মী তৈরি করতে পারছে না বেশির ভাগ সংগঠন। এ অবস্থায় অন্তত এক ডজন ছাত্র সংগঠন বর্তমানে ব্যানারসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি তো নয়ই, তারা নিয়মিত নিজেদের সাংগঠনিক সভাও করতে পারছে না। বিপরীতদিকে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলোয় একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতামূলক ও সুস্থ ধারায় না থাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। ছাত্র সংগঠনগুলো এ দাবির বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানালেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেভাবে পাশে পাচ্ছে না। এ অবস্থায় শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে পথ হারানো ছাত্র রাজনীতির আমূল পরিবর্তন এবং নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মুখে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলোচনা নতুন করে সামনে এসেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২০১৯ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতি না থাকায় তাদের ক্যাম্পাস ছিল নিরাপদ। এ সময়ে শিক্ষার্থী নিপীড়নের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। এজন্য তারা এখনো ছাত্র রাজনীতি চান না। অন্যদিকে ছাত্রলীগের দাবি, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকার কথা বললেও শিবির ও হিযবুত তাহরীর ভেতরে ভেতরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের অপতৎপরতা রুখতে স্বাভাবিক ছাত্র রাজনীতি চালুর কোনো বিকল্প নেই। এ অবস্থার মধ্যেই সোমবার উচ্চ আদালত বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন। তবে শিক্ষার্থীরা এখনো ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে অটল। এ অবস্থায় চলমান ধারার ছাত্র রাজনীতি কীভাবে বুয়েটে চলবে, তা নিয়ে সব মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এর আগে ২০২২ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রলীগ একযোগে ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি ঘোষণা করে। তখন ক্যাম্পাসের ভেতরে ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেই সময়েও ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলোচনা ছিল তুঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলোচনা কেন বারবার সামনে আসছে-এ নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র সংগঠনগুলো এখন মূলত মূল দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। তাদের ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি নেই বললেই চলে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়াচ্ছে তারা। এর পেছনে রয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্য ঘিরে অনেক ছাত্রনেতা বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছেন। এ নিয়েই মূলত ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে, যা শিক্ষার্থীদের মনে চরমভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ কারণেই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশের মতো ছাত্র রাজনীতি পৃথিবীর কোথাও নেই। বড় দলগুলোর হাত ধরে এগুলো বিকশিত হচ্ছে। একসময় বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বড়দের কোনো সম্পর্ক ছিল না। আদর্শিক জায়গা থেকে তারা কাজ করত। ছাত্রলীগেরও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও এর নেতারা যথেষ্ট আদর্শবাদী রাজনীতি করতেন। নেতারাও তা মেনে নিতেন। মূল দলের লেজুড়বৃত্তি ছিল না। এখনকার ছাত্র নেতৃত্ব তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য হারিয়েছে। তারা যে কাজগুলো করে, এর সঙ্গে ছাত্রদের স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, শিবির-সবাই একই রকম অবস্থায় আছে। বামপন্থি কিছু সংগঠন আদর্শ ধরে রাখতে কাজ করছে। তবে তাদের স্পেসও খুবই সংকীর্ণ হয়ে গেছে। আসলে বড় দলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এর প্রভাবই পড়েছে ছাত্র রাজনীতিতে।’ তিনি আরও বলেন, ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে না এমন দেশে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন ছিল কি না ভাবা উচিত ছিল। বিদেশেও ছাত্র রাজনীতি আছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ ইউজিসির সূত্র জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৪টি (কয়েকটি কার্যক্রমে নেই)। এর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র রাজনীতি রয়েছে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র রাজনীতির প্রভাব তুলনামূলক কম। বিপরীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংগঠনগুলো বেশি সক্রিয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর নেপথ্যে রয়েছে সিটের রাজনীতি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় প্রশাসন থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিট নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ। বিএনপি সরকারের আমলেও একইভাবে ছাত্রদল সিট নিয়ন্ত্রণ করত। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ ছিল শিবিরের হাতে। এর ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কখনোই স্বস্তি পায়নি। অপরদিকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। এ কারণে ছাত্র রাজনীতির আবেদনও ক্রমেই কমেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান ছাত্র রাজনীতি সেই গৌরবের ধারায় নেই। তবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে মুক্তচিন্তার বিকাশ, প্রগতিশীল ধ্যানধারণা এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা হবে না। এজন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার প্রশ্নই আসে না। বিষয়টি হলো ছাত্র রাজনীতিকে সংস্কার করে স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে হবে। তারা সংঘর্ষ-সহিংসতায় যাবে না, যৌন হয়রানি করবে না, হল দখল করবে না, চাঁদাবাজি করবে না, দলীয় ক্যাডার হিসাবে ব্যবহার হবে না। এগুলো না থাকলে ছাত্র রাজনীতি অনেক পরিশীলিত হবে, সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা থাকবে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করলে তা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। বুয়েটে যেভাবে একজন ছাত্রকে পিটিয়ে মারা হলো, এটা তো ছাত্র রাজনীতি হতে পারে না। এটা অপরাজনীতি। এগুলো বন্ধে শিক্ষকদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দলমত না দেখে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় যারা অপরাজনীতি করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কার্যকর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, নব্বই সালের পর থেকে দেখা যায় ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে এখন পর্যন্ত তেমন বড় কোনো ছাত্র আন্দোলন হয়নি। যেগুলো হয়েছে, সেটা দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে। যেমন: কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের আন্দোলন। বর্তমান ধারায় ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতিতে না জড়িয়ে কেবল লেখাপড়া, ভালো চাকরি কিংবা ব্যবসা-এই ট্রেন্ডটা বেশি দেখা যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হওয়ায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতে দেশপ্রেমের তাগিদও এদের মধ্যে কম। এ ধারা পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেই। এ কারণে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়েছে। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণ সংকট আরও ঘনীভূত করেছে। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া। এর মূল দায় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের। তারা কেউই ছাত্র সংসদ সংসদ নির্বাচনে আগ্রহী ছিল না। এ কারণেই ছাত্র রাজনীতির নামে পেশিশক্তিনির্ভর দখলদারি রাজনীতি ক্যাম্পাসে বিস্তৃত হয়েছে। এ কারণেই স্বার্থবাদী ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির ধারা থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দূরে থেকেছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে প্রশাসনের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নির্যাতনে অনেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে।’ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তিনি বলেন, ‘কার্যত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না। এর পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিকাশে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু করা প্রয়োজন। এটি ক্যাম্পাসগুলোয় শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’ সাধারণত অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনের মূল কার্যক্রম পরিচালিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাস পরিস্থিতি নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তালিকায় এমন ১৩টি ছাত্র সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে। এগুলো হলো-বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ) বিসিএল, বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি ন্যাপ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) মার্কসবাদী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। তবে এ তালিকার বাইরেও কিছু ছাত্র সংগঠন রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ সংগঠনগুলোর অধিকাংশই এখন সেই অর্থে রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। ছাত্র ইউনিয়নসহ অনেকের আবার পালটাপালটি কমিটি রয়েছে। সংগঠনগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ মাঝেমধ্যে কিছু কর্মসূচি করে। তবে ছাত্রলীগ নেতৃত্বাধীন কয়েকটি সংগঠনের মোর্চা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এখন অনেকটা নামসর্বস্ব অবস্থায় রয়েছে। এর বাইরে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্ট কিছু কর্মসূচি পালন করে। বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রগতিশীল ছাত্র জোটও কর্মসূচিতে আগের মতো সরব নেই। তবে নতুন নামে গড়ে ওঠা সাত সংগঠনের মোর্চা ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট’কে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যায়। আর ছাত্রদল ক্যাম্পাসের বাইরে রাজনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে কিছু কর্মসূচি পালন করলেও শিক্ষার্থীসংশ্লিষ্ট তেমন কোনো কর্মসূচিতে নেই। অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর বেশির ভাগেরই দেখা মেলে কেবল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে। এর বাইরে ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্রকাশ্য কর্মসূচি সেভাবে দেখা যায় না। এর মধ্যে শিবিরের প্রকাশ্য কার্যক্রম নেই বললেই চলে। তবে ছাত্রলীগ বরাবরই বলেছে, প্রকাশ্য রাজনীতি না করলেও তারা গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিদ্যমান ছাত্র সংগঠনগুলো দলীয় এজেন্ডার বাইরে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এজন্য শিক্ষার্থীরা রাজনীতিবিমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন আছে। তবে সেটি হতে হবে শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রম আরও জোরদার এবং সম্প্রসারিত করে তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরি করার মতো ছাত্র রাজনীতি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে মিলে যে ছাত্র রাজনীতি, সেটিকে আমাদের দেশের বাস্তবতায় উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এজন্য বর্তমান ছাত্র রাজনীতির মধ্যে আরও শৃঙ্খলা, সহনশীলতা এবং জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা জরুরি। এটি করতে পারলে ছাত্র রাজনীতি শিক্ষাঙ্গনের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।’ ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ এবং সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরদারে পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ আছে। আমাদের দেশেও ছাত্র সংসদ হলে শিক্ষাঙ্গন যদি হানাহানিমুক্ত রাখা যায়, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত না হয়, তাহলে সেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অবশ্যই প্রয়োজন আছে।’ ছাত্রনেতারা যা বললেন : ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু উদ্বেগ, শঙ্কা রয়েছে। এগুলো থাকাটাও খুবই যৌক্তিক। এ দায় ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিতে হবে। আমরাও সেটি নিতে চাই। বুয়েটের ক্ষেত্রে আমরা বলেছি, তারা নজির স্থাপন করুক। প্রয়োজনে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছাত্র রাজনীতির একটি ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ তৈরি করে দিক। যেখানে কখন, কীভাবে, কী ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে, তা ঠিক করে দিক। আমরা ইনক্লুসিভ ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠাতা করতে চাই।’ ছাত্রবান্ধব কর্মসূচির চেয়ে মূল দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ছাত্রলীগ বেশি মনোযোগী-এমন অভিযোগের বিষয়ে বলেন, ছাত্র রাজনীতির মৌলিক ভিত্তিই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের দুঃখ, বেদনা, সংকট, প্রত্যাশা পূরণ করা। এক্ষেত্রে যে সমালোচনাটি রয়েছে সেটি অতিক্রমের দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম বলেন, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে, এটা শতভাগ সত্য। এর মূল দায় ছাত্রলীগের। ১৬ বছর ধরে তারা ক্যাম্পাসগুলোয় শিক্ষার্থী নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছে। তারাই ছাত্র রাজনীতি কলুষিত করেছে। আর ছাত্রলীগের সব অপকর্ম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জায়েজ করে দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের সহযোগিতা করে। তাদের একক নিয়ন্ত্রণে ছাত্ররা অতিষ্ঠ। তারা শিক্ষাঙ্গনে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে গেলে হামলা চালিয়ে আমাদের ৫০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে পিটিয়ে জখম করে। অনেকে তাদের জন্য পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রাগীব নাঈম বলেন, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা জরুরি। এর আগে ছাত্রদলও একই কাজ করেছে। ক্যাম্পাসে তাদের একক নিয়ন্ত্রণের কারণে অন্য সংগঠনগুলো কাজ করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের কাছে আমরা যখনই যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তখনই বাধা এসেছে। হল প্রশাসন সিট বণ্টনের দায়িত্ব ছাত্রলীগের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এই সিট দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে সাধারণ ছাত্রদের ভিন্ন রাজনীতি করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।