পশ্চিম রেলের ৭ হাজার বিঘা জমি বেহাত


পশ্চিমাঞ্চল রেলের আমনুরা-গোদাগাড়ী সেকশনের দিগরাম-ঘুণ্টিঘর এলাকায় রেলের একটি বড় পুকুর অবৈধভাবে দখল ও ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ইসরাইল মোড়ল ও তার সহযোগীরা। দীর্ঘদিন রেলের সাড়ে তিন একর আয়তনের পুকুরটি দখলে নিয়ে ভোগ করছিলেন ইসরাইল। সম্প্রতি পুকুরটি ভরাট করেছেন। এখন তিন লাখ টাকা কাঠা করে প্লট বিক্রি করছেন। রেলের জমি প্লট করে বিক্রি করলেও পশ্চিম রেলের ভূসম্পত্তি বিভাগ খবরই পায়নি। স্থানীয়রা গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে অভিযোগ দিলেও গত দুই মাসে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পশ্চিম রেলের আমনুরা-গোদাগাড়ী সেকশন রেললাইনটি ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরপরই বন্ধ হয়। ১৯২৩ সালে নির্মিত ২৫ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেকশনে রেলের মোট জমির পরিমাণ ৭২০ একর। বর্তমান বাজার মূল্যে এ জমির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ জমির এক ছটাকও রেলের হাতে নেই। পুরোটাই বেদখল হয়েছে। আইন না থাকলেও এসব জমি হাতবদল হচ্ছে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ আমনুরা-গোদাগাড়ীর রেলবাজার পর্যন্ত পরিত্যক্ত রেললাইনটির ওপর দিয়ে পাকা সড়ক করেছে। তবে এলজিইডিও জমি ব্যবহারের অনুমোদন নেয়নি রেল থেকে। এভাবে পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে রেলের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। এসব জমি উদ্ধারে রেল কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তবে পশ্চিমাঞ্চল রেলের ভূ-সম্পত্তি শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লোকবল সংকট ও অর্থ না থাকায় তারা বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে অভিযানে নামতে পারছেন না। জানা গেছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার ৪১৯ একর। এর বর্তমান বাজার মূল্য দুই লাখ কোটি টাকার বেশি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন প্রকল্পের আরও তিন হাজার একর জমি। রেলের পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত প্রায় ১২ হাজার ৯ একর জমি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া রয়েছে। এসব ইজারা বাবদ পশ্চিম রেল সর্বশেষ অর্থবছরে ২৭ কোটি ৩ লাখ ২৩ হাজার ৫৬৭ টাকা রাজস্ব পেয়েছে। উত্তরে পঞ্চগড় থেকে দক্ষিণে বাগেরহাট এবং পূর্বে গাজীপুর থেকে পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল, বৃহত্তর ফরিদপুর, আংশিক গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগের অর্ধেকাংশ সেকশন লাইন রেলের পশ্চিম জোনের অধিভুক্ত। পশ্চিম রেলের সবচেয়ে বেশি জমি রয়েছে সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট, সান্তাহার, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ঈশ্বরদী, পাকশী, রাজবাড়ী ও চুয়াডাঙ্গা জেলায়। এসব এলাকায় দখলের পরিমাণও অনেক বেশি। রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল রেলের সদর দপ্তর। রেল ভূ-সম্পত্তি বিভাগের তথ্যমতে, সৈয়দপুর পৌরসভার যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ জমি দখল করে রাখা হয়েছে। রেল সূত্রে দাবি, ১৯৭৯ সালে রেলের ২৫ একর ৫০ শতক জমির লাইসেন্স ফি তোলার দায়িত্ব নেয় সৈয়দপুর পৌরসভা। চুক্তি অনুযায়ী লাইসেন্স ফির অংশ পৌরসভা ও রেলের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন হওয়ার কথা ছিল। প্রথম বছর রেলকে কিছু রাজস্ব দিলেও পৌরসভা পরে আর এক টাকাও দেয়নি। নথিতে ২৫ একর হলেও সৈয়দপুরে শতাধিক একর জমি পৌরসভার ছত্রছায়ায় দখলদারদের হাতে চলে গেছে। রেল সূত্রে আরও জানা গেছে, পশ্চিমাঞ্চজুড়ে রেলের জমি সবচেয়ে দখল হয়েছে আটটি জেলায়। এর মধ্যে সৈয়দপুরে আড়াই হাজার বিঘা, সিরাজগঞ্জের দুই হাজার বিঘা, রাজশাহীতে দেড় হাজার বিঘা, রাজবাড়ীতে দুই হাজার বিঘা, লালমনিরহাটে আড়াই হাজার বিঘা, চুয়াডাঙ্গা, ঈশ্বরদী ও পাকশীতে হাজার একর করে জমি বেদখল হয়ে রয়েছে। এছাড়া সান্তাহার জংশন, বগুড়া, খুলনা, কুষ্টিয়া, গোয়ালন্দঘাট, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, যশোর ও গাইবান্ধার বোনারপাড়া ও ফুলছড়ি ঘাট দিনাজপুরের পার্বতীপুর এলাকায় বিপুল পরিমাণ রেলভূমি বেহাত হয়ে রয়েছে। রেল সূত্রের দাবি, পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে একজন প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা, তিনজন বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা, তিনজন সহকারী ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা, চারজন সার্কেল কর্মকর্তা, ৯ জন কানুনগো, ১৮ জন আমিন, তিনজন মামলা পরিদর্শক, চারজন ট্রেসারসহ কয়েকজন কর্মচারী রয়েছেন। বিপুল পরিমাণ এই সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য বিদ্যমান জনবলের চারগুণ বেশি প্রয়োজন। পশ্চিম রেলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) রেজাউল করিম বলেন, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযানে গেলেই দখলদাররা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে হাজির হন। এস্টেট শাখায় মামলা পরিদর্শকের অভাবে এসব মামলার সার্বক্ষণিক তদারকি করা যায় না। এছাড়া দখলদারদের বিরুদ্ধে থানা পুলিশ মামলা নেয় না। আদালতে গেলেও মামলা পরিদর্শকের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে মামলা করা যায় না। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, মামলা আদালতে উঠলেও রেলের নিযুক্ত আইনজীবীরা অবহেলা করেন। কারণ রেলের মামলা পরিচালনা করে আইনজীবীরা সামান্য পরিমাণ ফি পান। ফলে রেলের সম্পত্তি বিভাগের জন্য যোগ্য আইনজীবীও পাওয়া যায় না। পশ্চিম রেলের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) অন্যতম প্রধান দায়িত্ব রেলওয়ের সম্পদ ও সম্পত্তি রক্ষা করা। কিন্তু সম্পত্তি রক্ষায় তাদের বিশেষ কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। দখলদারদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে স্থানীয় সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনও যথাযথ ভূমিকা পালন করে না। কোথাও দখলদার উচ্ছেদে গেলে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ পাওয়া যায় না। রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) ভূমিকাও প্রায় একই রকম। এছাড়া দখলদার উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নেই রেলের। উচ্ছেদ খাতে বিপুল খরচ হলেও বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ বরাদ্দে উচ্ছেদ যন্ত্রপাতির ভাড়ার টাকাও হয় না।