প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম
অনলাইন নিউজ ডেক্স
দেশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ফলে হতাহতের ঘটনা যেভাবে বাড়ছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্যও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ দায়ী বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। এ অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় অর্ধশত মানুষ। গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়েছেন অনেকেই। ফলে এ ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য বিশ্বের অনেক দেশে রান্নার কাজে এলপি গ্যাস ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশেও বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এর ব্যবহার বেশ উল্লেখযোগ্য। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমে যাওয়ায় সিলিন্ডারে বাজারজাত এলপি গ্যাসের চুলায় রান্নাবান্নার প্রচলন বেড়ে চলছে। কিন্তু সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা ব্যবহারে যে ঝুঁকি আছে এবং সেই ঝুঁকি এড়াতে যে ধরনের সচেতনতার প্রয়োজন, তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ফলে দেশে প্রতিনিয়ত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মানুষ মারা যাচ্ছে, দগ্ধ হচ্ছে। যারা গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করেন, তাদের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণেও অনেক সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা রোধে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের কিছু নিয়মকানুন আছে, যা ব্যবহারকারীদের মেনে চলা প্রয়োজন। কারণ, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে অসাবধানতায় অথবা সিলিন্ডারের ত্রুটির কারণে কিংবা হঠাৎ ঘটা দুর্ঘটনায় এটি গণবিধ্বংসী বোমার মতো ভয়ানক হতে পারে।
সিভিল ডিফেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৭৮টি, যা ২০১৭ সালের চেয়ে শতাধিক বেশি। পরবর্তী বছরগুলোতেও একের পর এক ঘটে চলেছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা। কারিগরি ত্রুটি, অসচেতনতা ও অসতর্কতার কারণেই যে দেশে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘Prevention is better than cure’, অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম, যা সত্য। দেশে এ ধরনের দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত ইতঃপূর্বে জনস্বার্থে একটি রিট করেছিলেন। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুলও জারি করেন। প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে বিবাদীদের ব্যর্থতাকে কেন ‘আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত’ বলা হবে না এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল ওই রুলে। জ্বালানি বিভাগ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে একটা পরিপত্র জারি করে। ওই পরিপত্রে তিনটি ধাপে সতর্কতা অবলম্বনের উপায় বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন-১. সিলিন্ডার রাখার জন্য নিরাপদ জায়গা নির্ধারণ করা; ২. রান্না শুরুর আগে ও শেষ হওয়ার পরে গৃহীত সতর্কতা এবং সিলিন্ডার রাখার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা এবং ৩. রেগুলেটরসহ সিলিন্ডারের খুঁটিনাটি সব পরীক্ষা করে রান্নাঘরে যথাযথভাবে বাতাস আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
কথায় বলে, সাবধানতার মার কম। সুতরাং, গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেমন যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, তেমনি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারকারীদেরও এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা ও নিয়ম মেনে চলা উচিত। যেমন-চুলার পাশে আগুনের উৎস থেকে কমপক্ষে ২-৩ মিটার দূরত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় সিলিন্ডার স্থাপন করা প্রয়োজন। সিলিন্ডারের মুখে কাগজে মোড়ানো সিল আছে কিনা, তা দেখে নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সিল থাকার অর্থ হচ্ছে, ভেতরে গ্যাস যথাযথভাবে পরিপূর্ণ আছে। এরপর সিল সরিয়ে প্রেশার রেগুলেটরের ওপর সংযোগ ক্লিপ লাগাতে হবে। সুইচ অন করে দেখতে হবে ক্লিপের সঙ্গে রেগুলেটর সঠিকভাবে লেগেছে কিনা। তবে এসব কাজ অভিজ্ঞ লোক দিয়ে করিয়ে নেওয়া উত্তম। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে, যেন রান্নার জায়গা আলো-বাতাসযুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে এবং রান্নাঘরের জানালা খোলা থাকে। এছাড়া মানসম্মত রাবার টিউব অথবা হোস পাইপ ব্যবহার করা, রাবার টিউব অথবা হোস পাইপে সাবানের ফেনা লাগিয়ে লিকেজ চেক করা, দুই বছর পরপর নতুন রাবার টিউব লাগানো উচিত। এলপিজি সিলিন্ডার যদি অব্যবহৃত থাকে অথবা গ্যাসহীন অবস্থায় থাকে, তাহলে রেগুলেটরের নব বন্ধ করে রাখা উচিত। প্রয়োজনবোধে সিলিন্ডার ভর্তি থাকার সময় সেফটি ক্যাপ ব্যবহার করা, রান্না শেষে চুলা ও রেগুলেটর উভয়ের সুইচ বন্ধ করে রাখা, টিউবে লিকেজ হয়েছে কিনা, তা নিয়মিত চেক করা এবং এক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে তা দ্রুত পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
এসবের পাশাপাশি গ্যাস সিলিন্ডার অবশ্যই শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার ক্রয়ের আগে অবশ্যই তা অনুমোদিত ডিলারের কাছ থেকে কেনা প্রয়োজন। তাছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার বাঁকা বা শুইয়ে না রেখে সর্বদা সোজা বা খাড়া করে রাখতে হবে। টিউব, রেগুলেটর কিংবা অন্য কোনো অংশ লিকেজ হয়েছে কিনা, তা চেক করতে ম্যাচের কাঠি বা লাইটার অথবা আগুন জ্বালানো যাবে না। সিলিন্ডার ও চুলার সংযোগ পাইপের সঙ্গে কোনো কিছু প্যাঁচানো যাবে না। একটি সিলিন্ডার থেকে একাধিক সংযোগ দেওয়া যাবে না। নিুমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা থেকে সর্বদা বিরত থাকতে হবে। আরও যা উচিত তা হলো-গরম টিউব ব্যবহার না করা, টিউব গরম হলে তা দ্রুত পরিবর্তন করা, সিলিন্ডারের আশপাশে মোবাইল ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার না করা।
অনাকাঙ্ক্ষিত আগুনের সূত্রপাত হলে তা নিভিয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে হাতের কাছে সর্বদা দুই-এক বালতি পানি রাখা ভালো। পরিস্থিতি বিবেচনাসাপেক্ষে দ্রুত বাসার বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি কাছের গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অথবা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া প্রয়োজন। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে উপরোক্ত সতর্কতা ও নিয়মকানুন সঠিকভাবে মেনে চললে দেশে গ্যাস সিলিন্ডারজনিত দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা; রিসার্চ ফেলো, ম্যাথারাথ (সিনাওয়াটরা) ইউনিভার্সিটি, থাইল্যান্ড
kekbabu@yahoo.com
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।