প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও অনুশাসন উপেক্ষিত জীর্ণ রেল সেতুতে পদে পদে বিপদ
অনলাইন নিউজ ডেক্স
জীর্ণ রেল সেতু দিয়ে বছরের পর বছর ধরে ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন। কোথাও সেতুর দুপাশের মাটি সরে গেছে। আবার কিছু সেতুর নাট-বল্টু, স্লিপার, ক্লিপ-হুক কিংবা ফিশপ্লেটও নড়বড়ে। এ অবস্থায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো কোনো ব্রিজ এলাকায় ৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করায় ঝুঁকির যাত্রায় বিভিন্ন সময় সেতু ভেঙে ট্রেন দুর্ঘটনায় যাত্রী হতাহতসহ রেল সম্পদও নষ্ট হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলো রাজস্ব খাত থেকে মাঝেমধ্যে সংস্কার করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। প্রয়োজন নতুন করে ব্রিজ নির্মাণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৯০ শতাংশ রেল ব্রিজই ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। অধিকাংশেরই মেয়াদ শেষ। শত বছর পুরোনো ঝুঁকির এসব ব্রিজ দিয়েই ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখার অসম চেষ্টা। ফলে উনিশ থেকে বিশ হলেই ট্রেন লাইনচ্যুতিসহ দুর্ঘটনা ঘটছে।
রেল সূত্র জানায়, রেলওয়েতে মোট ৪ হাজার ৫৮৬টি সেতু রয়েছে। যার অধিকাংশ প্রায় শত বছরের। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব ব্রিজ বেশিরভাগই শুধু ইট-বালি-চুন দিয়ে তৈরি। ব্রিটিশ আমলের কোনো ব্রিজে রড-সিমেন্ট ছিল না। এর ফলে প্রকৌশলীদের ফোরকাস্ট অনুযায়ী এসব ব্রিজ ২০-২৫ বছর হলেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। সেতু সংস্কারে সম্পৃক্ত এক প্রকৌশলী জানান, রড সিমেন্টবিহীন এসব সেতুর পিলার দিন দিন নরম হয়ে পড়ে। ফাটল ধরে, দেবে যায়। জীর্ণ সেতুগুলোর পিলার টিকিয়ে রাখতে-রড-সিমেন্টের সমন্বয়ে জ্যাকেট সিস্টেম আস্তর দেওয়া হচ্ছে। শত শত সেতু বছরের পর বছর ধরে আস্তর দিয়ে টিকিয়ে রাখার অসম চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অথচ এমনও গুরুত্বপূর্ণ সেতু রয়েছে-পূর্বাঞ্চল রেলে মেজর ব্রিজ ১৫৫টি এবং পশ্চিমাঞ্চল রেলে ২৫০টি। বহু ‘মেজর ব্রিজ’ রয়েছে বহু বছরের পুরোনো-জীর্ণ।
এছাড়া পূর্বাঞ্চল রেলে ৯টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ১৬টি কেপিআইভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ রয়েছে। একইসঙ্গে পুরো রেলপথে ১ হাজার ২২৫টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। অবৈধ লেভেল ক্রসিং এলাকায় ঝুঁকির ব্রিজও আছে। রেলে ব্রিজ এলাকায় সাধারণত লেভেল ক্রসিং করা হয় না। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তদবির করে লেভেল ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে জরাজীর্ণ সেতু এবং এসব অবৈধ লেভেল ক্রসিংকেন্দ্রিক এলাকায়। সেতুর উপরে থাকা রেলপথের স্লিপার সবই কাঠের। কাঠের স্লিপারগুলোও নড়বড়ে, ভেঙে থাকে অনেকাংশে।
এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘রেলে পুরাতন লাইনের সেতুগুলো নিশ্চয় খুব পুরোনো। অধিকাংশ রেলপথই ব্রিটিশ আমলের। ওই সময়ের সেতুগুলো এখনও মেরামত করে ঠিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা সরেজমিন অনুসন্ধান করার নির্দেশনা দিয়েছি। এছাড়া সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, মেরামত কিংবা জোড়াতালি দিয়ে নয়, নতুন প্রকল্প তৈরি করে যথাযথ মেরামত এবং পুরাতন ব্রিজের স্থলে সম্পূর্ণ নতুন ব্রিজ তৈরি করা হবে। তিনি দাবি করেন, সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছে। অত্যাধুনিক গতির ট্রেনও রেলবহরে যুক্ত হচ্ছে। কারণ অতি পুরাতন ব্রিজ দিয়ে গতির ট্রেনগুলো পূর্ণ গতি নিয়ে চালানো সম্ভব হবে না। তিনি মনে করেন, রেলওয়ে ব্রিজগুলো গুণগত মানের হলে ট্রেনের গতি যেমন বাড়বে-তেমনি ঝুঁকি ও দুর্ঘটনা কমবে। এজন্য শুধু রাজস্ব খাত থেকে নয়-প্রকল্প তৈরি করে যথাযথ বরাদ্দের মাধ্যমে পুরাতন ব্রিজগুলো তৈরি-মেরামত করা হবে।’
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানায়, জীর্ণ পুরাতন ব্রিজ মেরামত করে সচল রাখা বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। তাছাড়া বৃষ্টি বেশি হলে কিংবা পাহাড়ি ঢলে প্রায় পুরাতন ব্রিজের দুপাশ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বিভিন্ন সেকশনে ট্রেন বন্ধ রেখে মেরামত করতে হচ্ছে ব্রিজ ও ব্রিজের দুই পাড়। আবার কখনও পুরো লাইন পানির তোড়ে ভেঙে পড়ে, এমনকি অনেক সময় পুরো সেতু ধসে পড়ে।
বর্তমানে ৩ হাজার ৮৫ দশমিক ৭ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এরমধ্যে পূর্বাঞ্চল রেলে ১৩৮৬.৮৯ কিলোমিটার এবং পশ্চিমাঞ্চল রেলে ১৬৯৮.৮১ কিলোমিটার। কিন্তু এসব রেলপথ ঘিরে ৪ হাজার ৫৮৬টি রেলসেতুর অধিকাংশই জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ব্রিজগুলো কবে নাগাদ নির্মাণ করা হবে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রেলসেতু) মো. লিয়াকত শরীফ খান বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলের রেললাইনে যতগুলো ব্রিজ রয়েছে তার অধিকাংশ প্রায় শত বছর বয়সি। আমরা এসব ব্রিজ মেরামতে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকি। অধিকাংশ ব্রিজের পিলারগুলো শুধু ইট দিয়ে তৈরি। রড নেই। ত্রুটি কিংবা ফাটল দেখা দিলে আমরা ব্রিজগুলোকে জ্যাকেট সিস্টেমে মেরামত করি। তাছাড়া ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রেখেই মেরামতের কাজ করতে হয়। পুরাতন ব্রিজগুলো নতুন করে নির্মাণ করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। তবে তিনি মনে করেন, পশ্চিমাঞ্চলের রেলে থাকা ২ হাজার ৫০০ ব্রিজের অধিকাংশ পুরাতন। এগুলো আগে মেরামত অথবা নতুন করে নির্মাণ করা প্রয়োজন।’
এদিকে পূর্বাঞ্চল রেলে ব্রিজ রয়েছে ২ হাজার ৮৬টি। যার অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলের। এখানে একই অবস্থা। প্রকৌশলী বিভাগের (সেতু) দায়িত্বরত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আখাউড়া-সিলেট ১৭৬.৭২ কিলোমিটার রেলপথের সবকটি ব্রিজ ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া বাকি ব্রিজগুলোর অধিকাংশই পুরাতন। সংগতকারণে এসব ব্রিজের কার্যকর সংস্কার অথবা নতুন করে নির্মাণ করতে হবে।’
রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেলের একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে। গত ১৫ বছরের প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। চলমান রয়েছে আরও প্রায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে রেলের জরাজীর্ণ লাইন ও রেলওয়ে ব্রিজ উন্নয়নে কোনো নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। জীর্ণ ব্রিজগুলো ভেঙে নতুন ব্রিজ তৈরির কোনো প্রকল্পও গৃহীত হয়নি। অথচ খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও অনুশাসন ছিল দ্রুত সময়ের মধ্যে রেলের পুরনো ব্রিজ-লাইন দ্রুত মেরামত এবং প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। ২০২০ সালে দেওয়া এ নিদের্শনা ও অনুশাসন এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ট্রেন, ব্রিজ, পানি শোধনাগারসহ একগুচ্ছ উন্নয়ন কাজের উদ্বোধনকালে এ নির্দেশনা দেন।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. আরিফুজ্জামান বলেন, রেলের পুরাতন ব্রিজগুলো আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। আমরা মাঠপর্যায়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বিভিন্ন মাধ্যমে মেরামত করছি। কিন্তু এসব ব্রিজ নিয়ে সব সময় সতার্কাবস্থাতে থাকতে হয়। তিনি জানান, ‘আমি নতুন দায়িত্বে এসেছি, খোঁজ নিয়ে বলব।’
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।