দেশে পক্ষকালব্যাপী তীব্র দাবদাহ বইছে। যশোর, চুয়াডাঙ্গাসহ অনেক জেলার তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে।
প্রলম্বিত তীব্র দাবদাহে ফল-ফসলের মাঠ পুড়ছে। হিট শকে মাঠের বোরো ধানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে গ্রামে বিদ্যুৎচালিত সেচ ব্যবহারে বিঘ্ন ঘটছে। এ কারণে শেষ মুহূর্তে বোরো ধানের জমিতে পানি দেওয়া যাচ্ছে না।
এতে ধানে অতিমাত্রায় চিটার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ মৌসুমি ফল মুকুলেই ঝরে পড়ছে। মাঠেই রোদের তাপে পুড়ে মরে যাচ্ছে ভুট্টা, কলাসহ নানা ধরনের ফসল। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র বলছে, এপ্রিলজুড়েই বইবে তাপপ্রবাহ। এ সময়ে বৃষ্টির সম্ভাবনাও তেমন নেই। ফলে ফল-ফসলের ক্ষতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।
বর্তমানে মাঠে আছে বোরো ধান। অধিকাংশ এলাকায় বোরো ধানের শিষ বের হয়েছে। এ মুহূর্তে জমিতে পানি থাকতেই হবে। গাছের গোড়া শুকিয়ে গেলে আর্দ্রতার অভাবে ধান চিটা হয়ে যাবে। ফলে উৎপাদন কমে যাবে। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলে ধানে চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেখানে এবার তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় ধানে ফুল অবস্থায় পানি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধানগাছের গোড়ায় ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখা দরকার। সেটা সম্ভব না হলে জমি অবশ্যই ভেজা থাকতে হবে।
এ পরিস্থিতিতে কৃষিবিদদের প্রধান পরামর্শ-ধান, আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ ফলের গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিশ্চিত করা গেলে রোদের তাপ যতই বাড়ুক তাতে ফসলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।
বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, পটোল, শসা ও ঢ্যাঁড়শ প্রভৃতি খেতে তিন-চারদিন অন্তর সেচ দিতে হবে। অন্যদিকে পাতাজাতীয় সবজি যেমন : ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, কলমি, লাউশাক প্রভৃতি খেতে দুই-তিনদিন অন্তর সেচ প্রয়োগ করতে হবে। বারির কর্মকর্তারা বলছেন, প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া উত্তম। দাবদাহ কমলেও সবজি গাছের ফল সংগ্রহ শেষ হওয়া পর্যন্ত পাঁচ-সাতদিন অন্তর সেচ অব্যাহত রাখতে হবে, এতে ফলন বাড়বে। মাটিতে পর্যাপ্ত রস ধরে রাখার জন্য সেচের পর গাছের গোড়ায় মালচিং করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ফসল ও ফলের গাছে পানি দিতে হলে বিদ্যুৎ দরকার। কিন্তু গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ খুবই নাজুক। গড়ে ৩-৪ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ তেমন কোথাও থাকে না। ফলে অনেক এলাকায় ফল ও ফসলের গাছে পানি দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁয় পানির সংকট রয়েছে। স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক পানির পাম্প বিকল হয়ে গেছে। পানি সমস্যার কারণে ফল ও ফসলে সঠিক সময়ে পরিমাণমতো পানি দেওয়া যাচ্ছে না বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান। বরেন্দ্র আঞ্চলে পানি সংকট সবচেয়ে বেশি।
সেচ সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) শীবেন্দ্র নারায়ণ গোপ বলেন, দাবদাহের কারণে ফল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংকট রয়েছে, এটা সত্য। তবে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোনো খবর আসেনি যে পানির সংকটে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বিদ্যুৎ যখন সরবরাহ হয়, তখন তো পানি উত্তোলন করে ধরে রাখা হচ্ছে এবং পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিএডিসির পাম্পগুলো এখনো সচল আছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সেখানে অনেক পাম্পও বিকল হয়েছে। বিষয়টি বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ-এ তিন জেলায় এ সমস্যা হয়েছে বলে জানি। আর কোথাও থেকে সেচ সমস্যার কথা এখনো শোনা যায়নি।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন ধানের খেতে বেশি পানি লাগবে না। বরং শুধু ধানের জমি তথা খেত ভেজা থাকলেই চলবে। কারণ, এখন ধান বের হচ্ছে এবং দিনে দিনে পরিপক্ব হবে। শুরুতে যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন, এখন সেই পরিমাণ পানি না দিলেও চলবে। তবে প্রতিদিনই ধানগাছের গোড়ায় পানি থাকতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহ জাহান কবির বলেন, ধানের গাছে গোড়ায় পানি দিতে হবে। বিশেষ করে যে ধান এখন কেবল বের হচ্ছে-এমন ধানগাছের গোড়ায় পানি থাকা জরুরি। পানির অভাবে ধান চিটা হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনই দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে আশার খবর হচ্ছে দিনে তাপমাত্রা বাড়লেও রাতে আবার তা কমে যাচ্ছে। ফলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা কম। তারপরও বলব, ধানগাছের গোড়ায় পানি নিশ্চিত করতেই হবে। এটা কৃষককে অবহিত করতে জেলায় জেলায় উপপরিচালক, উপজেলা পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা এবং মাঠ পর্যায়ের ব্লাক সুপারভাইজারদের বলা হয়েছে।
অপরদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক কেজেএম আব্দুল আওয়াল বলেন, লিচু, আম, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। চারদিকে রিং টাইপ গর্ত করে পানি দিতে পারলে ভালো। এছাড়া মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ইউরিয়া ও বলাইনাশক ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পরিমাণমতো গাছের পাতায় ছিটাতে হবে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে ব্রি (বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট) কৃষককে নানা পরামর্শ দিয়েছে। পরামর্শগুলো হলো কাইচ থোড় থেকে শক্ত দানা অবস্থায় থাকা ধানগাছ তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষার জন্য জমিতে সর্বদা ৫-৭ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে হবে, এ সময় জমিতে যেন পানির ঘাটতি না হয়। এ অবস্থায় ধানের শিষ ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে। রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগেই প্রিভেনটিভ হিসাবে বিকালে ট্রপার ৮ গ্রাম ১০ লিটার পানি অথবা নেটিভো ৬ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে পাঁচদিন ব্যবধানে দুইবার স্প্রে করতে হবে। ধানে বিএলবি ও বিএলএস রোগ ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ৬০ গ্রাম থিওভিট, ৬০ গ্রাম পটাশ ও ২০ গ্রাম জিংক ১০ লিটার পানিতে সমভাবে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।
দেশের পশ্চিম-উত্তর অঞ্চলের যেখানে পানির তীব্র সংকট, সেখানে অবশ্যই সেচের পর সময়মতো মালচিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। মালচিংয়ের ক্ষেত্রে কচুরিপানা, খড়, গাছের পাতা অথবা আগাছা প্রভৃতি গাছের গোড়া থেকে একটু দূরে ব্যবহার করতে হবে। জৈবসারের পানি ধারণক্ষমতা বেশি, সেজন্য জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে।
গাছে পুষ্টি কম থাকলে গাছের প্রয়োজনমতো পুষ্টি উপাদান (ইউরিয়া, এমওপি, বোরন, জিংক) মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে তারপর সেচ দিতে হবে। যেসব অঞ্চলে তীব্র পানি সংকট ও দাবদাহ, সেখানে গাছে সকালে অথবা বিকালে পানি স্প্রে করতে বলা হয়েছে। রোগ ও পোকামাকড় দমনের জন্য বালাইনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োজন অনুযায়ী ৭-১০ দিন বিরতিতে স্প্রে অব্যাহত রাখতে হবে। যেসব সবজিতে সকালে ফুল ফুটে, সেগুলোয় বিকালে এবং যেসব সবজিতে বিকালে ফুল ফুটে, সেগুলোয় সকালে স্প্রে করতে হবে।
বারির গবেষকরা বলছেন, মাটির বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে আমগাছে ৭-১০ দিন অন্তর সেচ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য ফল যেমন: লিচু, জামরুল, জাম, কাঁঠাল প্রভৃতি গাছেও ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন। বেসিন পদ্ধতিতে (গাছের চারপাশে রিং তৈরি করে) সেচ দেওয়া উত্তম। প্লাবন পদ্ধতিতেও সেচ দেওয়া যাবে। দাবদাহ কমলেও ফল পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত ১৫ দিন অন্তর সেচ অব্যাহত রাখতে হবে। এতে ফল ঝরে পড়া কমবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।