প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পে দিনে লোকসান ২৭ লাখ


ঠিক এক বছর আগে ২৮ অক্টোবর নানা আশ্বাস ও সম্ভাবনার ফুলঝুরি দিয়ে উদ্বোধন করা হয়েছিল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেল ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’। সম্ভাবনা তো দূরের কথা, প্রতিদিন যে টাকা আয় হচ্ছে টানেল থেকে, খরচ হচ্ছে প্রায় চারগুণ। জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে টানেলটির ব্যয় নির্বাহে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। বিপরীতে আয় হচ্ছে মাত্র ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। সে হিসাবে বিশাল এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরকারের লোকসান গুনতে হচ্ছে ২৭ লাখ ৯ হাজার টাকারও বেশি। তাই এটিকে বিগত সরকারের একটি উচ্চাভিলাষী ও মারাত্মক ভুল প্রকল্প বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। ঋণের টাকায় নির্মিত প্রকল্প থেকে আয় তো দূরের কথা, প্রতিদিনের ব্যয় তোলাও সম্ভব না হওয়ায় টানেলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সূত্র জানায়, গত বছরের আজকের দিনে টানেলটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পরদিনই শুরু হয় যান চলাচল। এর পর থেকে গত এক বছরে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশই ছিল হালকা যান বা ছোট গাড়ি। বাসের পরিমাণ ছিল ১০ শতাংশ। ট্রাক ছিল ১২ শতাংশ। অন্য বড় ট্রেইলারের পরিমাণ ছিল ১ শতাংশেরও কম। প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে ৩ হাজার ৯১০টি। চালুর এক বছরের মাথায় দেখা যায়, টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে যান চলাচল করছে মাত্র ৩ হাজার ৯১০টি। অর্থাৎ সমীক্ষায় দাবি করা সংখ্যার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক গাড়ি চলাচল করছে টানেল দিয়ে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বন্দর নগরী ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করতে এই একটি টানেল কতটা দরকার ছিল, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকরা সঠিকভাবে পর্যালোচনা করেননি। যেহেতু প্রকল্পের ব্যয় বেশি, তাই এখান থেকে কোনোদিন প্রত্যাশিত আয় হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামসুল হক বলেন, সে সময় টানেলটি নির্মাণের ডিসিশন নিতে রাজনীতি বেশি হয়েছে। সরকারের আমলারা নিজেদের জাহির করতে প্রকল্পটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে হাজির করতে গিয়ে ভুল সমীক্ষা সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছেন। যোগাযোগ বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করছে ও আয় হয়েছে, সেটি আস্তে আস্তে আরও কমতে পারে। উদ্বোধনের পর প্রথম মাস অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে টানেলে গাড়ি চলাচল করেছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২টি। সে হিসাবে ওই মাসে প্রতিদিন গাড়ি চলেছে ৫ হাজার ৫৪৪টি। টানেলের উপ-প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, টানেল একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটিকে লোকসানি প্রকল্প বলা যাবে না। টানেলটি ‘শ্বেত হস্তী’ নয়তো: ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে সব উচ্চ খরচের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, তার মধ্যে কর্ণফুলী নদীর নিচে এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল একটি। প্রতিদিনের ব্যয়ের বিপরীতে টোল আদায় থেকে ৩০ শতাংশ টাকা উঠছে না। এ ধরনের প্রকল্পকে সাধারণ ‘শ্বেত হস্তী’ প্রকল্পই বলা হয়ে থাকে অর্থনীতির ভাষায়। প্রায় ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্প কেন এত লোকসান গুনছে—তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, ২৩০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের পর টানেল দিয়ে যান চলাচলের পরিমাণ আরও বাড়বে। আগামী কয়েক বছরে এটি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা যাবে না। কাজেই এখান থেকে আয় করে সেই টাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তবে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও বে-টার্মিনাল সম্পূর্ণরূপে চালু হলে হয়তো এই টানেলের সুফল পাওয়া যাবে।