বজ্রপাতে ১৩ জেলায় মৃত্যু বেশি


প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতে দেশের ১৩টি জেলায় মৃত্যু বেশি। জেলাগুলো হলো সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, গাইবান্ধা, পাবনা ও দিনাজপুর। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। হিলিয়ন জার্নালে প্রকাশিত ‘জিআইএস-বেজড স্পেশাল অ্যানালাইসিস ফর লাইটিনিং সিনারিও ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৫-২০২২ সালে ৮ বছরে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি ১৪০ জন মারা গেছেন সুনামগঞ্জে। একই সময়ে ১১১ জনের মৃত্যু নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে হবিগঞ্জ জেলা। এরপরই নওগাঁয় ৮২, কিশোরগঞ্জে ৭৮ এবং ময়মনসিংহে ৭৭ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও একই সময়ে বজ্রপাতে রাজশাহীতে ৬৭, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৬৫, সিরাজগঞ্জে ৬৪, নেত্রকোনায় ৬৩, সিলেটে ৬১ এবং পাবনা ও গাইবান্ধায় ৫৩ জন করে মারা গেছেন। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে দেশে ২১৪২ জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ৫৩৮ জন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে পাওয়া জেলাভিত্তিক মৃত্যুর তথ্যের সঙ্গে এসব তথ্যের মিল পাওয়া যায়। অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, দেশে প্রতিবছর বাড়ছে বজ্রপাতে মৃত্যু। ২০১৯ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৯৮ জন, ২০২০ সালে তা ছিল ২৫৫ জন। কিন্তু ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল-তিন বছরে বজ্রপাতে গড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০ জনের অধিক ছিল। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ১৯ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছেন ৫৬ জন এবং আহত হয়েছেন ১৩ জন। বাংলাদেশের বজ্রপাতবিষয়ক আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সালে দেশে বজ্রপাতে গড়ে মারা গেছেন ৩০ জন আর আহত হয়েছেন ২২ জন। ২০০০ থেকে ২০০৯ সালে গড়ে মারা গেছেন ১০৬ জন এবং আহত হয়েছেন ৭২ জন। অন্যদিকে ২০১০ থেকে ২০১৭ সালে প্রতিবছর গড়ে মারা গেছেন ২৬০ জন এবং আহত হয়েছেন ২১১ জন। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০০ জন মারা যান এবং এ সংখ্যা অনেক। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর বজ পাতে ২০ জনের কম মারা যান। আবহাওয়াবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ পাতে মৃত্যুর এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিক বজ ঝড় ও বজ পাত হওয়ার মতো আবহাওয়া তৈরি হয়ে আছে। হিলিয়নে প্রকাশিত গবেষণার অন্যতম গবেষক ও আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, প্রাক-বর্ষা সময়ে তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং এ সময় বজ ঝড় হয়। যেটিকে আমরা কালবৈশাখী বলি। কখনো কখনো এর সঙ্গে থাকে শিলাবৃষ্টি। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে তাপমাত্রা যদি ১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পায়, তাহলে তীব্র আবহাওয়া ব্যবস্থা (সিভিয়ার ওয়েদার সিস্টেম) ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। ইন্টার গর্ভনমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) এমনটাই বলেছে গ্লোবাল স্টাডি অনুযায়ী। সিভিয়ার ওয়েদারের এই অবস্থার মধ্যে অত্যধিক তাপপ্রবাহ, দাবানল, অধিক বজ পাত, টর্নোডো, শিলাবৃষ্টি অন্যতম। গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে বজ পাত বৃদ্ধির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন দৃঢ়ভাবে জড়িত। এ পরিবর্তন সামুদ্রিক ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরন এবং চরম তাপমাত্রাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপত্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, এপ্রিলে তাপমাত্রা অধিক থাকে, যেটি জলীয় বাষ্পকরণকে ট্রিগার করে। যার ফলে মেঘ তৈরি হয়, বৃষ্টিপাত ও বজ পাত ঘটায়। এতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ভারতীয় উপমহাদেশে বজ পাতের একটি হটস্পট, প্রাক-বর্ষা মৌসুমে (মার্চ-মে) প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ৪০টি স্ট্রাইক হয়। উইলিয়াম আর. কটন, জর্জ ব্রায়ান ও সুসান সি ভ্যান ডেন হিভার রচিত ‘স্ট্রম অ্যান্ড ক্লাউড ডাইনামিক্স’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ১৬ মিলিয়ন বজ ঝড় হয়। প্রতিদিন হয় প্রায় ৪৫ হাজার বজ ঝড় আর প্রতিমুহূর্তে প্রায় ২ হাজার। তথ্যমতে, বছরে বিশ্বে ২৫ মিলিয়ন বজ পাত হয়। বিশ্বের তাপমাত্রা যদি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তাহলে এ বজ পাতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সরকার বজ পাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এটিকে দুর্যোগ হিসাবে দাপ্তরিকভাবে ঘোষণা করেছে। আজও (২০ মে) কয়েকজন মারা গেছেন। মৃত্যুর এ হার কোথায় গিয়ে ঠেকে আমরা জানি না। গড়ে প্রতিবছর এ সংখ্যা এখন ৩০০ প্লাস। বজ পাতে এত মৃত্যু আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, আমরা দেখেছি ১৮-১৯ জেলায় বজ পাত বেশি হচ্ছে। সরকার তালগাছ রোপণের প্রজেক্ট নিয়ে মানুষকে উৎসাহিত করেছিল। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, এটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত নয় যে, তালগাছ লাগালেই বজ নিরোধ হবে। এখানে সচেতনতা বড় বিষয়। আমরা সচেতনতার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছি। বেশি বজ পাতপ্রবণ কয়েকটি জেলায় কিছু বজ পাত নিরোধক যন্ত্র (লাইটনিং অ্যারেস্টার মেশিন) বসানো হয়েছে। এ যন্ত্রগুলো খুব কম পরিসরে বজ পাত আটকাতে পারে, তবে আমদানি পণ্য হিসাবে দাম অনেক। বজ পাতে মৃত্যু প্রতিরোধে আমাদের উদ্যোগ আছে। প্রকল্প আকারে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারা সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। তিনি বলেন, বজ পাতের পূর্বাভাস খুব আগে দেওয়া যায় না। আবহাওয়া অধিদপ্তর হয়তো ৩০ বা ৪০ মিনিট আগে পূর্বাভাস দিতে পারে। কিন্তু এখানে মূল সমস্যা সচেতনতার অভাব। আকাশে যখন কালো মেঘ হয়, তখনই একজন মানুষকে তার জীবনরক্ষার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া উচিত। পায়ে জুতা থাকতে হবে। উঁচু গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। খোলা জায়গায় বা মাঠে থাকলে কী করতে হবে, সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু আমরা দেখি আকাশে মেঘ দেখলে অনেকেই আরও উৎসাহ নিয়ে মাছ ধরতে যান, খোলা মাঠে কাজ করতে থাকেন। এসব বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে। আমাদের অনেক নির্দেশনা আছে এ বিষয়ে। গবেষক ও আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বিশ্বে বজ পাতে হতাহতের হাত থেকে বাঁচার জন্য থার্টি থার্টি নিয়ম মেনে চলা হয়। এ বিধিটি হলো, বজ ঝড় তৈরি হয়েছে-এমন অবস্থা বোঝার পর প্রথম একটি বিজলি চমকালে তারপর থেকে ৩০ পর্যন্ত গোনা শুরু করতে হবে। এ ত্রিশ গোনার মধ্যেই আকাশ ডেকে উঠলে বুঝতে হবে বজ ঝড়টি কাছাকাছি আছে। এরপর কমপক্ষে ৩০ মিনিট ঘরে অবস্থান করতে হবে। বাইরে বের হওয়া যাবে না। এভাবে প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা কমানো সম্ভব।