বাংলাদেশ ব্যাংকের জবাবদিহিতা চায় আইএমএফ


আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে ক্ষমতা আরও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অগ্রাধিকারভিত্তিক যেসব খাতে ঋণ দেওয়া হয় সেগুলো বন্ধ করতে বলেছে। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে নগদ অর্থ জমা রাখে (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) সে হার বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধনের সুপারিশ করেছে। ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে এর দর নির্ধারণ করার কথাও সংস্থাটি জোর দিয়ে বলেছে। শুক্রবার রাতে আইএমএফের প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ : প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রতিবেদন-সুদের হারের করিডর গ্রহণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের একটি মিশন গত বছরের ৫ থেকে ১৭ জুলাই বাংলাদেশ সফর করে গেছে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও আইনি কাঠামো পর্যালোচনা করেছে। এর ভিত্তিতে তারা তৈরি করেছে প্রতিবেদনটি। এর আগে গত বৃহস্পতিবার আইএমএফ বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের তৃতীয় কিস্তির অর্থ বাবদ ১১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার ছাড় করেছে। আগামী নভেম্বরে আইএমএফের আরেকটি মিশন আসবে ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি মূল্যায়ন করতে। মূল্যায়ন ইতিবাচক হলে আগামী ডিসেম্বরে পাওয়া যাবে চতুর্থ কিস্তির অর্থ। এজন্য ডিসেম্বরের মধ্যেই ওইসব শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাত, বৈদেশিক মুদ্রা বাজার ও স্থানীয় মুদ্রা বাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেশ কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বলেছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি মুদ্রানীতির বিষয়ে তাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সূত্রমতে, বর্তমানে মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণয়ন করলেও অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সরকারের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হয়। ফলে মুদ্রানীতিতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ে। দায় নিতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। আইএমএফ বলেছে, মুদ্রানীতি দ্বারা আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে পরিচালিত করতে হবে। এর মাধ্যমেই আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি, সুদের হার, ডলারের দাম এসব মুদ্রানীতির বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সূত্র জানায়, বর্তমানে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হলেও এটি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ডলারের দাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরোপিত পদ্ধতিতে নির্ধারণ হচ্ছে। মুদ্রানীতির বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহারের কার্যকারিতা সব ক্ষেত্রে মিলছে না। আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে জবাবহিদিতার অভাব রয়েছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্ষদের ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজে সরকারের হস্তক্ষেপ বাড়ছে। যে কারণে কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। ব্যাংক খাতের বর্তমান দুরবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবহিদিতা ও সুশাসনের অভাবকে দায়ী করা হয়। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক খাগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অর্থ দিয়ে তহবিল গঠন করে কম সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। আইএমএফ এসব খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে বলেছে। সংস্থাটির মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতের নীতি প্রণয়ন ও তদারকি করবে। তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো ঋণ বিতরণ করলে তদারকি ব্যবস্থায় বিঘœ ঘটবে। বর্তমানে নীতিনির্ধারণী সুদহার হিসাবে ট্রেজারি বিল পুনরায় কিনে নেওয়ার চুক্তি বা রেপো রেটকে নীতিনির্ধারণী সুদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আগে নীতিনির্ধারণী সুদ হিসাবে ব্যাংক রেটকে বিবেচনা করা হতো। আইএমএফ বলেছে, নীতিনির্ধারণী সুদ হিসাবে বর্তমানে আবার ব্যাংক রেটকে বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমানে ব্যাংক রেট ৪ শতাংশ। এটি নীতিনির্ধারণী সুদহার না হওয়ায় এটি বাড়ানো হচ্ছে না। বরং সুদের হার বাড়াতে নীতিনির্ধারণী সুদ হিসাবে রেপো সুদের হার বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে তাদের মোট আমানতের ৪ শতাংশ অর্থ নগদ আকারে বা সিআরআর হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এ হার আগে আরও বেশি ছিল। ব্যাংকগুলোতে তহবিলের পর্যাপ্ত বা তারল্য বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআর জমার হার কমিয়েছে। এতে ব্যাংকে তারল্য বেড়েছে। আইএমএফ বলেছে, আমানতকারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যাংকগুলোর সিআরআর জমার হার আরও বাড়াতে হবে। সিআরআর ঘাটতির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা জরিমানার ব্যবস্থায়ও সংস্কার আনার সুপারিশ করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে ডলারের দাম নিরূপণ পদ্ধতিতেও বড় সংস্কার আনার সুপারিশ করা হয়েছে। বাজারে ডলারের প্রবাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে এর দর নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করতে হবে। এখন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাস দিতে হবে। এটি দিলে মুদ্রা বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সুদের হারের গতিবিধি বোঝা যাবে। বাজারভিত্তিক ও প্রতিযোগিতামূলক সুদহার নির্ধারণে তারল্যের আগাম পূর্বাভাস ভ‚মিকা রাখবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে লক্ষ্যভিত্তিক আর্থিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।