বিদায় ২০২৩


খ্রিষ্টীয় বছর ২০২৩ তার সমাপ্তির চূড়ান্ত বারতা ছড়িয়ে দিয়েছে। অনেক পাওয়া-না পাওয়া, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার গল্প নিয়ে আজকের সূর্যাস্তের পর শুধুই স্মৃতির ডায়েরি হবে সে। আগামীকালের ভোর পৃথিবীর কাছে নতুন বছর ২০২৪ এর সুবাস নিয়ে হাজির হবে। বিশ্বের মানুষের কামনায় রবে শুধুই সুন্দর আগামীর স্বপ্ন। তবু বারবার ২০২৩-এর দিকে ফিরে তাকাবে স্মৃতিকাতর হয়ে। বিদায়ি বছর সবার জীবনে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০২৩ একটি ঘটনাবহুল বছর। ব্যক্তি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে চড়াই-উতরাই আর নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে গেছে বছরটি। আসছে বছর ২০২৪ এর ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার ঠিক আগের বছরটি নির্বাচনের বছর হিসাবেই অভিহিত ছিল। নির্বাচনকে ঘিরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র পালটাপালটি কর্মসূচি, রাজপথ দখল, সংঘাত-ই ছিল বিদায়ি বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বছরের শেষ দিকে এসে যার ফলাফল বিএনপির নির্বাচন বর্জন এবং আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ। নির্বাচন ঘিরেই সারা বছর আলোচনায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কর্মকাণ্ড এবং ইইউসহ পশ্চিমা বিশ্বের বাংলাদেশ নিয়ে নানা বিবৃতি ও তৎপরতা। বিদায়ি বছরের শুরু থেকেই সরকারের পতনে পদযাত্রা, অবস্থান কর্মসূচি, গণমিছিল ও রোড মার্চ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে ছিল বিএনপি। আওয়ামী লীগ তার চেয়েও জোরালোভাবে রাজপথেই ছিল। বিএনপির কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে পালটাপালটি কর্মসূচি ছাড়াও নানাভাবে সারা বছরই সরব ছিল দলটি। বিএনপিসহ অন্যান্য দলের ধারাবাহিক কর্মসূচিগুলো শান্তিপূর্ণভাবে চলতে থাকলেও ২৮ অক্টোবর ঢাকায় দলটির মহাসমাবেশ ঘিরে পরিস্থিতি পুরোপুরি পালটে যায়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত এবং আহত হওয়ার বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। বিশ্ব মিডিয়ায়ও ফলাও করে তা প্রচার হয়। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিএনপির নির্বাচনের দাবি থাকলেও তাতে কোনো সাড়া মেলেনি। এমনকি, নভেম্বরে নির্বাচন সামনে রেখে সংলাপের জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠিও দিয়েছিলেন আমেরিকার দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তবে ওই প্রস্তাবকে ‘সময় নেই’ জানিয়ে নাকচ করে দেয় আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদধারীসহ অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন নেতা দল ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নেন। দলের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম এবং আন্দোলনের সঙ্গী বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়রম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো সারা বছরই নানা বিবৃতি এবং বক্তব্য দিয়েছে। এসব বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে জবাব হিসাবে রাশিয়া, চীন তাদের অবস্থান জানিয়েছে। অবস্থান স্পষ্ট করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতও। চলতি বছরের ২৪ মে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে আমেরিকা। যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধা দেবে বা এই কাজে সহযোগিতা করবে তাদের ভিসা দেবে না আমেরিকা। এই ভিসানীতিতে দেশের বর্তমান-সাবেক সরকারি-বিরোধী দলীয় যে কেউ পড়তে পারেন। পাশাপাশি থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের সদস্যরা। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের সেলফি বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের বরফ গলার লক্ষণ হিসাবে আলোচিত হয়। ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণার আগে থেকেই বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস আলোচনায় চলে আসেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে নাক গলানোর অভিযোগও উঠে তার বিরুদ্ধে। যদিও পিটার হাস সব সময়ই বলেছেন, আমেরিকা বাংলাদেশের বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে নেই। পুরো বছরেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা ছিল সাধারণ মানুষ। কথায় কথায় হঠাৎ করেই দাম বাড়ানো হয়েছে মাছ, মাংস, ডিম ও শাক-সবজিসহ নানা পণ্যের। সাধারণ ভোক্তা ও ছোট ব্যবসায়ীরা আঙুল তোলেন সিন্ডিকেটের দিকে। কথিত এই সিন্ডিকেটকে সরকার যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বলেও অভিযোগ ছিল সাধারণ মানুষের। একপর্যায়ে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও এতে তেমন কাজ হয়নি। সারা বছর রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ কমে যাওয়া নিয়ে নানা আলোচনা ছিল সর্বমহলে। ডলার সংকট এবং ডলারের দাম বৃদ্ধিতে বিদেশযাত্রা, বিদেশে চিকিৎসা, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশগমন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য এলসি খোলাসহ নানা ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। খোলাবাজারে ডলারের দর উঠে যায় ১২৯ টাকায়। ডলার বাজারের এই অস্থিরতার সুযোগ নেয় অনেক ব্যাংকও। সারা বছরই আলোচনায় ছিল আইএমএফের ঋণ। এরই মধ্যে ঋণের দুই কিস্তি দিয়েছে আইএমএফ। সবশেষ আলোচনায় আসে টাকার সংকটে পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম হওয়ার বিষয়। বিদায়ি বছরে ‘দেশটা তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন’-এক বিচারপতির এমন মন্তব্যে দেশজুড়ে আলোচনা হয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিনের জামিন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ বিরোধিতা করায় উষ্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। আদালত তাদের উদ্দেশে এই মন্তব্য করেন। বিদায়ি বছরে দেশে প্রথমবারের মতো ‘সর্বজনীন পেনশন’ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি সব বাংলাদেশি নাগরিক এতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছরের বেশি বয়সিরাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণিতে করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতানির্ভর পড়াশোনায় জোর দেওয়া হয়েছে। এতে বদলে গেছে চিরাচরিত পড়াশোনার পদ্ধতি। শিক্ষাক্রমে এমন বিশাল পরিবর্তনে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা ছিল সারা দেশেই। মেট্রোরেল চালু হয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহণ করছে। যেটি ঢাকার যানজটে নাকাল অনেকের জন্য স্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা সেতুতে শুরু হয়েছে ট্রেন চলাচল। ঢাকা থেকে কক্সবাজার ট্রেন চালু হওয়া নিয়ে সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল সবাই। বছরের শুরুতে ১২ জানুয়ারি ও ২৮ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় নির্বাহী আদেশে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়া কর্তৃক ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মাধ্যমে ৫ অক্টোবর পারমাণবিক শক্তির যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু ছিল আলোচিত বিষয়। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন (২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৩ লাখ ২০ হাজার ১৫৮ জন রোগী। বিদায়ি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ১৬৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল ফিলিস্তিনে ইসরাইলিদের নির্বিচারে নারী-শিশুসহ মানুষ হত্যা। ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। প্রাণ হারায় অন্তত দেড় হাজার মানুষ। তারপরই অপারেশন ‘আয়রন সোর্ড’ শুরু করে ইসরাইলি সেনারা। বোমার আঘাতে কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে গাজা। এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ হাজার ফিলিস্তিনি। ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে সুদানে। ৬ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে তুরস্ক ও সিরিয়া। বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রতি বছর আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিদায়ি ২০২৩ সালে দাবদাহ ভুগিয়েছে বিশ্বের নানা অঞ্চলের মানুষকে।