বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে গচ্চা ৮ হাজার কোটি টাকা


গ্যাসের জোগান নিশ্চিত না করেই খুলনায় ৩টি পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ গচ্চা দিয়েছে সরকার। কেন্দ্রগুলো থেকে কখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে, তা সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে পারছে না। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, কেন্দ্রগুলো চালানোর জন্য যে জ্বালানি (গ্যাস) লাগবে, তা এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, তালিকায় নাম না থাকার পরও দেশের প্রভাবশালী ৪ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিককে গ্যাস দিতে গিয়ে সরকারি তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দেওয়া সম্ভব হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ক্ষমতা ছাড়ার কিছুদিন আগে এ ৪টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। একটি কেন্দ্রে গ্যাস দেওয়া হয় ২০২৩ সালের শেষদিকে। চারটি কেন্দ্রই ছিল গ্যাস পাইপলাইনের অগ্রভাগে। এ কারণে পাইপলাইনে গ্যাস থাকলে, তা আগেই দ্রুত ওই কেন্দ্রগুলো টেনে নিত। ফলে তালিকায় থাকলেও সংকট দেখিয়ে খুলনার তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে রূপসাসহ ৩ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবিষ্যৎ। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। কারণ, রূপসার ৮০০ মেগাওয়াটসহ আরও ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে তৈরি হয়েছে। খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ঘনিষ্ঠ ৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিককে গ্যাস দেওয়ার কথা ছিল আরও পরে। এর আগে গ্যাস যাওয়ার কথা ছিল খুলনার রূপসাসহ ৩ বিদ্যুৎকেন্দ্রে। সে অনুযায়ী কেন্দ্র ৩টির নির্মাণকাজও দ্রুত শেষ করা হয়। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এ তিন পাওয়ার প্ল্যান্টের মালিক। জানতে চাইলে এনডব্লিউপিজিসিএল-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম খোরশেদুল আলম বলেন, পেট্রোবাংলা থেকে শতভাগ কনসার্ন নিয়েই আমরা এ বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করেছি। আলোচ্য প্রকল্পে গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলা থেকে নিশ্চয়তা প্রদানের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে জ্বালানি বিভাগকে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে অনুরোধ করা হয়। ওই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি পেট্রোবাংলা এ প্রকল্পে ২০২০ সাল নাগাদ রি-গ্যাসিফাইড এলএনজি সরবরাহের মাধ্যমে গ্যাস প্রদানের নিশ্চয়তাপত্র দেয়। ২০১৮ সালের ২২ মে একনেক রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপিপি অনুমোদন করে। পেট্রোবাংলা থেকে গ্যাস সরবরাহের নিশ্চিয়তাপ্রাপ্তি এবং একনেক থেকে প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট সরকারের সঙ্গে এডিবির ঋণচুক্তি সই হয়। তিনি আরও বলেন, পেট্রোবাংলা ২০২০ সালের মধ্যে এ কেন্দ্রে গ্যাস দিতে পারবে বলায় এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) লোন দিয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রটি পরিদর্শন করেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান। মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। মূল সমস্যা জ্বালানি। ইতোমধ্যে এডিবির তরফ থেকেও পেট্রোবাংলার কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে কেন তারা কথা দিয়ে এত বড় ইনভেস্ট করাল? জানা যায়, খুলনার রূপসাসহ নির্মাণাধীন ৩ বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ শিগগিরই মিলছে না। এ কারণে কেন্দ্রগুলো চালু করা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব গ্রহণ করেই এ প্রকল্পগুলো নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের জোগান নিশ্চিত না করেই কেন নির্মাণ প্রক্রিয়া, তা জানতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে তিনি খুলনায় গিয়ে প্রকল্পগুলো দেখেও এসেছেন। এ নিয়ে তিনি এডিবির প্রতিনিধির সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের জোগান নিশ্চিত করতে ভোলা থেকে খুলনা পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণে এডিবির সহযোগিতা চেয়েছেন উপদেষ্টা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ভোলা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন করা হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে খুলনা থেকে গ্যাসের পাইপলাইনও যুক্ত করা হয়ে গেছে। তবে গ্যাস না থাকায় লাইন থাকলেও সেটি কাজে আসছে না। এ কর্মকর্তা বলেন, পরিকল্পনা ছিল ভোলা থেকে খুলনা পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন হবে। তবে বাস্তবতা হলো, ভোলা থেকে খুলনা পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইনের কোনো অগ্রগতি নেই। পরে পরিকল্পনা হয়, ভারতের কোম্পানি এইচ এনার্জির মাধ্যমে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের সরবরাহ করা হবে। সেই কাজটিও পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয়নি। এছাড়া এখন বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে-খুলনার রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আরও দুটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেষ হলেও গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদনে যাওয়া অনিশ্চিত। তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কাজ প্রায় শেষদিকে। আরও ২০০ মেগাওয়াাট সক্ষমতার আরেকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ৩২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার একটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। নির্মাণাধীন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ শিগ্গিরই মিলছে না। ফলে কেন্দ্রগুলো চালু করা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পেট্রোবাংলা সূত্র জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করা হলেও ২০২৭ সালের আগে গ্যাস পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আরও তিন বছর। বিষয়টি নিয়ে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, নর্থ ওয়েস্ট যে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে, সেগুলো পেট্রোবাংলা থেকে মতামত নিয়েই বাস্তবায়ন করেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের জোগান নিশ্চিত না করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার মানে হলো রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়। অনেক উন্নয়ন প্রকল্প হয়েছে লুটপাটের জন্য। পেট্রোবাংলার লোকজন অফিসে বসে বসে মতামত দিয়েছে। রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকল পাওয়ার প্ল্যান্ট (সিসিপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্রটি খুলনার শিল্পাঞ্চল খালিশপুরের রূপসায় ৫০ একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে। ২০১৮ সালে শুরু এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ সম্পন্নের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের জুনে। এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। গত জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮১ দশমিক ৯২ শতাংশ, আর্থিক অগ্রগতি ৪৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ, উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৮৮০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য ২৮ মার্চ সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিসিএল) সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি (জিএসএ) হয়েছে। সে অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শীতকালে টেস্টিং-কমিশনিংয়ের জন্য এসজিসিএল গ্যাস সরবরাহ করবে। নির্ধারিত সময়ে গ্যাস পাওয়া গেলে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কমিশনিং করা যাবে। তবে ২০২৭ সালের জানুয়ারি থেকে বেইজ লোডে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ আছে। তাই ২০২৭ সালের আগে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে না। সে পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণে রাখতে হবে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হবে ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে। নদীর নিচ দিয়ে শাহবাজপুর থেকে পটুয়াখালীতে গ্যাস পাইপলাইন করার পরিকল্পনা ছিল। সেখান থেকে এ গ্যাস যাবে খুলনায়। এ পথে গ্যাসের লাইন টানা হয়েছে। কিন্তু পটুয়াখালীতে এখন পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন সংযোগ না হওয়ায় খুলনায় গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ভোলা থেকে পটুয়াখালীতে নদীর নিচ দিয়ে গ্যাসলাইন টানার জন্য ইতোমধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে পেট্রোবাংলা। এরপর আর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।