বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশন জট কমাতে শিক্ষার্থীদের ওপর ১শ টাকা চাঁদা


অবসরে যাওয়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রায় ৬০ হাজার আর্থিক দাবি পূরণে বিকল্প পন্থা তৈরি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১শ টাকা করে আদায় করা হবে। প্রতি বছর ভর্তির সময়ে এই টাকা দেবে তারা। এ ছাড়া এসএসসি এইচএসসি, ডিগ্রি এবং মাস্টার্স ফরম পূরণকালেও পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে একই হারে টাকা আদায় করা হবে। এর মধ্যে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তি ও ফরম পূরণের টাকা শিক্ষা বোর্ডগুলো সংগ্রহ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের নির্দিষ্ট হিসাবে পাঠাবে। আর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের টাকা সরাসরি কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে মহাপরিচালকের হিসাবে জমা হবে। পরে ওই টাকা অবসর বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টের নির্দিষ্ট হিসাবে জমা পড়বে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ২১৭ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ হবে। এই অর্থ দিয়ে উভয় সংস্থা বর্তমানের তুলনায় গড়ে ৪ হাজার জনের আর্থিক দাবি অতিরিক্ত পূরণ করা যাবে বলে জানা গেছে। আর্থিক দাবির দীর্ঘ জট নিরসনে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অর্থ পরিশোধেও নতুন পন্থা অবলম্বনের চিন্তা চলছে। সরকারি কর্মচারীদের মতো অবসরের এক বছরের মধ্যেই সংশ্লিষ্টদের মোট প্রাপ্য অর্থের অর্ধেক পরিশোধ করা হবে। বাকি অর্ধেক অথ থেকে আজীবন নির্দিষ্ট হারে পেনশন আকারে দেওয়া হবে। যদি দাবিদার শিক্ষক বা কর্মচারী মারা যান তাহলে তার নমিনি হিসাবে স্ত্রী বা স্বামী আমৃত্যু পেনশন পাবেন। জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমদ বলেন, মাধ্যমিক স্তরে ভর্তিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১শ টাকা করে আদায়ের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন স্কুল থেকে ওই টাকা রোভার স্কাউট বা গার্লস গাইড ফি’র মতো বোর্ডের হিসাবে জমা পড়বে। পরে সেখান থেকে অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় যাবে। আর ২০২৪ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ওপর ১শ টাকা করে চাঁদা আরোপ করা হবে। একইভাবে বেসরকারি কলেজ, কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসায় স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি এবং পরীক্ষার ফরম পূরণেও ১শ টাকা চাঁদা ধার্য করা হবে। এ বিষয়ে শিগগিরই অফিস আদেশ জারি করা হবে। আর সরকারি জনবলের মতো বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদেরও পেনশন চালুর প্রস্তাব আছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই আর্থিক টানাপড়েনে হয়তো এখনই সম্ভব হচ্ছে না। তবে আর্থিক সক্ষমতা ফিরে পেলে হয়তো এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবে। জানা গেছে, দেশে বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে (ইংরেজি মাধ্যম বাদে) শিক্ষার্থী আছে ১ কোটি ২৭ লাখ ২৯ হাজার ১৭৯ জন। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী। এছাড়া কলেজ-মাদ্রাসায় ডিগ্রি ও অনার্সে লেখাপড়া করে ২১ লাখ ৯২ হাজার ৬৬২ জন এবং মাস্টার্সে পড়ে ২ লাখ ৪২ হাজার ৩৭৩ জন। বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া এই ১ কোটি ৮১ লাখ ৬৪ হাজার ২১৪ শিক্ষার্থীর কাছ থেকেই ভর্তির সময়ে ১শ টাকা করে নেওয়া হবে। তাদের মধ্যে ইতোমধ্যে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গত জানুয়ারিতে আদায় করা হয়েছে। এখন যারা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা যখন একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হবে তখন তাদের কাছ থেকেও একই হারে আদায় করা হবে। এছাড়া ২০২৪ সালে প্রায় ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি ও এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষা দেবে। তাদের কাছ থেকে ফরম পূরণকালে একইভাবে চাঁদা নেওয়া হবে শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ২১৭ কোটি টাকা আদায় হবে। এই টাকার ২৫ শতাংশ কল্যাণ ট্রাস্ট এবং বাকিটা অবসর সুবিধা বোর্ড পাবে। এই অর্থে বছরে উভয় সংস্থা থেকে গড়ে অতিরিক্ত ৪ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের বর্তমানে দুটি সংস্থা থেকে অবসর সুবিধা দেওয়া হয়। এরমধ্যে একটি হচ্ছে অবসর সুবিধা বোর্ড, অপরটি কল্যাণ ট্রাস্ট। সাধারণত কল্যাণ ট্রাস্টের তুলনায় আড়াই গুণ অর্থ বেশি দেওয়া হয় অবসর সুবিধা বোর্ড থেকে। বোর্ড তিনটি এই আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য দু’টি উৎস থেকে তহবিল পেয়ে থাকে। একটি উৎস হচ্ছে-কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) থেকে চাঁদা হিসাবে প্রতি মাসে অর্থ কেটে রাখা হয়। এর মধ্যে অবসর বোর্ড পায় ৬ শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্ট ৪ শতাংশ। অপর দুটি উৎস হচ্ছে-জাতীয় বাজেট থেকে সময়ে সময়ে বিশেষ বা থোক বরাদ্দ এবং বিভিন্ন সময়ে সরকারের দেওয়া গচ্ছিত বা সিডমানির লভ্যাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, তহবিল সংকটের সঙ্গে দুটি বোর্ডে কিছু অনিয়মও আছে। এছাড়া দুর্নীতি তো আছে। এ কারণে প্রথমত, আর্থিক দাবিদারের সংখ্যা বাড়ছে, দ্বিতীয়ত, সেবা প্রার্থীদের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে ঘুসের শিকার হওয়ার অভিযোগ আসে। সেবা প্রার্থীদের অভিযোগ, অবসর বোর্ড ইনক্রিমেন্ট ধরে আর্থিক সুবিধার মোট অঙ্ক হিসাব করে। কিন্তু অর্থ দেয় না। সংস্থাটির সর্বশেষ হিসাবে অর্থের দাবিদার সাড়ে ২৪ হাজার। গত বছর জানুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৯ হাজার। কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ে আরও সাড়ে ৯ হাজার বেশি আবেদনকারীর জট আছে অবসর বোর্ডে। এই সংখ্যাটি প্রায় ৩৫ হাজার। এটি নিষ্পত্তিতে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা দরকার। বর্তমানে অবসর বোর্ড প্রতি বছর গড়ে ৮ হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করে। এ খাতে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ৮শ কোটি টাকা। কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে এই সংখ্যা আড়াই গুণ হওয়ার কথা। তবে প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। কল্যাণ ট্রাস্টের জটে থাকা আবেদন নিষ্পত্তি করতে ২ হাজার কোটি টাকা দরকার। জানা গেছে, অবসর সুবিধা বোর্ডে বর্তমানে ৬৬৭ কোটি টাকা সিড মানি। আসন্ন বাজেটে সরকার আরও ৫শ কোটি টাকা সিডমানি দেবে বলে আশ্বাস পাওয়া গেছে। এছাড়া অতিরিক্ত ২শ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ আসবে জট দূর করার জন্য। এই অর্থে কমপক্ষে ২শ দাবি নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এই সংস্থায় প্রতি মাসে তিনটি উৎস থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে শিক্ষকদের দাবি মেটানোর পরও ৪৩ কোটি টাকা ঘাটতি থাকে বলে জানান এই সংস্থার সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী। আর কল্যাণ ট্রাস্টে কত টাকা সিডমানি আছে সেই তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে এই সংস্থায় সিড মানির লভ্যাংশ এবং এমপিও চাঁদা থেকে যে অর্থ আসে তা দিয়ে দাবি পূরণের পরও প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকা ঘাটতি থাকে বলে জানান সংস্থাটির সচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু। উল্লিখিত দুই শিক্ষক নেতা আরও বলেন, বছরে উভয় সংস্থায় প্রায় সাড়ে ৬শ কোটি টাকা ঘাটতি থাকে। শিক্ষার্থীদের চাঁদা থেকে সোয়া ২শ কোটি টাকা এলেও জট দূরে তেমন ভূমিকা রাখবে না। তাই হয় এই চাঁদার পরিমাণ আরও বাড়ানো দরকার, নতুবা সরকারকে প্রতি বছর অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা করে বিশেষ বরাদ্দ ও ১ হাজার কোটি টাকা সিডমানি দেওয়া উচিত। এতে ২০২৪ সালের মধ্যে জট নিরসন করে নতুন পেনশন ব্যবস্থায় যাওয়া সম্ভব হবে। এতে সরকারের ওপর শিক্ষকদের সন্তুষ্টি আরও বাড়বে।