বৈদেশিক এলসির বকেয়া দায় ৯৪০০ কোটি টাকা


আগে রপ্তানি খাতের কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসি’র কোনো দায় বকেয়া থাকত না। করোনার সময় থেকে এ খাতে সময় মতো দায় পরিশোধ করতে না পারায় বকেয়া থাকছে। গত জুন পর্যন্ত এ খাতে বকেয়া স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৫ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯ হজার ৪০০ কোটি টাকা। তবে গত বছরের জুনের তুলনায় এ খাতে দায়ের স্থিতি কমেছে ৩২ কোটি ডলার। যা স্থানীয় মুদ্রায় তিন হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসি’র দায় কমেছে ২৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। রপ্তানি খাতের সার্বিক চিত্র নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয় ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির বিপরীতে কাঁচামালের মূল্যের পুরোটাই রপ্তানিকারকদের নামে ঋণ হিসাবে ইস্যু করে পরিশোধ করে ব্যাংক। রপ্তানির মূল্য দেশে আসার পর ব্যাংক ঋণ বাবদ দেওয়া অর্থ সমন্বয় করে বাকি অর্থ রপ্তানিকারকের হিসাবে স্থানান্তর করে। এ কারণে এ ধরনের ঋণকে নিরাপদ মনে করে ব্যাংক অর্থায়ন করে। আগে এসব খাতের এলসির কোনো দায়দেনা বকেয়া থাকত না। করোনার সময় বৈশ্বিক লকডাউনের কারণে নিয়মিত রপ্তানি আয় দেশে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে ব্যাংক রপ্তানি আয় থেকে ঋণ সমন্বয় করতে পারছিল না। এ কারণে এ খাতে বকেয়া বাড়তে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, করোনার কারণে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসি’র দায় বকেয়া হয়েছিল ৯৪ কোটি ১৩ লাখ ডলারের। যা মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণের ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল এক হাজার ১৮৩ কোটি ডলার। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্যে করোনার নেতিবাচক প্রভাব শেষ না হতেই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাবে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও কমে যায়। এতে ডলারের সংকট প্রকট হয়। লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে ডলারের দাম। ডলারের সংকট প্রকট হলে বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির বকেয়া দায় বাড়তে থাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ১১৬ কোটি ৬৮ লাখ ডলারে। যা মোট স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে মোট স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ছিল এক হাজার ৭৭৬ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির বকেয়া দায় বেড়েছিল ২৩ কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার ছিল ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ডলার সংকট মোকাবিলায় আমদানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে আমদানি কমতে থাকে। বৈশ্বিক মন্দায় পণ্য রপ্তানিও কমতে থাকে। এর প্রভাবে রপ্তানির অর্ডার আসা যেমন কমে, তেমনি কাঁচামাল আমদানিও কমে যায়। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতের বৈদেশিক এলসির বকেয়া দায়ও কমতে থাকে। গত বছরের জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৮৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলারে। যা বেসরকারি খাতে মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণের ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আগের অর্থবছরের চেয়ে কমেছে ৩২ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় তিন হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। কমার হার ২৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ওই বছরে মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল এক হাজার ৩৬৬ কোটি ডলার। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়েছিল ৮৩৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৯৫৩ কোটি ডলার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় এলসি খোলা ৩১ শতাংশ এবং আমদানি ১৯ শতাংশ কমেছিল। গত অর্থবছরের জুলাই অক্টোবরে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়েছিল ৩১৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয় ৩০৮ কোটি ডলার। ওই সময়ে এলসি খোলা কমেছে ২ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে ওই সময়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় আমদানি হয়েছিল ৩৭৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের আমদানি হয়েছে ২৭৫ কোটি ডলার। যা ২৬ দশমিক ১৮ শতাংশ কম। গত নভেম্বরে মোট ৮০ কোটি ডলার ও চলতি ডিসেম্বরে ৭৫ কোটি ডলারের ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে। অর্থাৎ ব্যাক টু ব্যাক এলসি কমছে। এটি কমার কারণে আগামীতে রপ্তানি আয়ও কমতে পারে। গত জুন পর্যন্ত অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের পরিমাণ প্রায় ১৩৫ কোটি ডলার। বৈশ্বিক মন্দায় বিদেশি ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেকে পণ্যমূল্য পরিশোধ করতে পারছে না। এ কারণে রপ্তানি আয় দেশে আসছে কম। ডলার সংকট মোকাবিলা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয়ে গত পৌনে দুই বছর ধরে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বৈশ্বিক মন্দা ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামালের আমদানিও কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে রপ্তানি খাতে পড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে নতুন আতঙ্ক হিসাবে দেখা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতিতে শ্রমিক অধিকারের বিষয়টি।