বৈধ ভিসা নিয়েও ওরা কানাডা যেতে পারলেন না কেন?


সম্প্রতি সিলেটের ৪২ জন যাত্রী কানাডার উদ্দেশে যাত্রাকালে বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের বিমানবন্দরের ট্রানজিট এলাকা থেকে ফেরত যেতে বাধ্য করেছে। এই ৪২ যাত্রী কানাডার ভিসা পেয়েছিলেন। তারা সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিধিসম্মতভাবে ইমিগ্রেশনসহ যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন করেছিলেন। পরে কানেকটিং ফ্লাইটে ঢাকায় আসার পর কানাডাগামী বাংলাদেশ বিমানে ওঠার সময় তাদের বাধা দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর ছাপা হয়; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। যাত্রীদের কাছ থেকে জানা যায়, তারা যখন বোর্ডিং পাশ নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যাত্রী ট্রানজিট লাউঞ্জে ঢাকা-টরন্টো বিমানে আরোহণের অপেক্ষা করছিলেন, তখন বিমানের গ্রাউন্ড কর্মচারীরা তাদের নাম ডেকে তাদের কাছ থেকে বোর্ডিং পাশ নিয়ে নেন। তারপর তাদের কাছে হোটেল বুকিংয়ের কাগজপত্র দেখতে চান। যাত্রীরা তাদের ভাড়া করা বাড়ির কাগজ দেখালে সেটা বিমানের কর্মচারীদের মনঃপুত হয় না। তারা বারবার হোটেল বুকিংয়ের কথা বলতে থাকেন। এ অবস্থায় নিরুপায় হয়ে যাত্রীরা বিমানবন্দরে বসে তৎক্ষণাৎ হোটেল বুকিং করেন। এর পরও বোর্ডিং পাশ ফেরত না দিয়ে সারারাত বসিয়ে রেখে পরদিন দুপুরবেলা তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, তাদের কাছে যেহেতু বৈধ ভিসা ছিল, সেহেতু তারা গন্তব্যে পৌঁছে কোথায় থাকবেন, না থাকবেন সেটা দেখার এখতিয়ার তো গন্তব্য দেশের কর্তৃপক্ষের, বিমান কর্তৃপক্ষের নয়। আর যেহেতু তাদের ভিসা দেওয়া হয়েছে, সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন সাপেক্ষেই কানাডা সরকার তাদের ভিসা দিয়েছে। তাহলে তাদের কানাডা যেতে বাধা দেওয়া হলো কেন? পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বিমানের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, যাত্রীরা যে নিমন্ত্রণপত্রের মাধ্যমে ভিসা পেয়েছেন সেটা নাকি ছিল ভুয়া। এর জবাবে বলতে হয়-পাঁচ বা দশ বছর মেয়াদি ভ্রমণ ভিসা প্রদান তো নিশ্চয়ই শুধু একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য দেওয়া হয়নি। আর এটাও কারও অজানা নয় যে, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমা দেশ তো বটেই, এমনকি আমাদের আশপাশের দেশগুলোর ভিসা পেতেও আমাদের কী ধরনের কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখন প্রশ্ন, এই কানাডাগামী ৪২ জনের যাত্রা রোধ করে সংশ্লিষ্টরা কার স্বার্থ রক্ষা করল? এতে কার লাভ হলো-ব্যক্তির, দেশের, নাকি অন্য কারও? ২. বাংলাদেশের বিমানবন্দর ও রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার বিরুদ্ধে বিদেশে যাতায়াতকারী দেশের মানুষের বা প্রবাসীদের অভিযোগের শেষ নেই। প্রায়ই আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিমানের লোকসান, দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর দেখি। বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি ছাড়া আমাদের জাতীয় বিমান সংস্থার বিমানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকা খুব কম মানুষকেই পাওয়া যাবে, যারা তাদের অসন্তুষ্টির কথা বলেননি। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বিদেশি এয়ারলাইনসে ভ্রমণকারীদের মুখে প্রায়ই সেসব এয়ারলাইনসের সার্ভিসের প্রশংসাসূচক গল্প শুনি। তার পরও মানুষ শত অনিয়ম ও ভোগান্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিমানে যাতায়াত করে দেশের প্রতি টান ও ভালোবাসার কারণে। যখন আমরা দেশের বিশাল বেকার জনসংখ্যার মানুষদের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা করতে পারছি না; যখন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা শ্রম মন্ত্রণালয় অথবা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশে শ্রমবাজার খোঁজার কাজে দেনদরবার করে চলেছে, তখন নিজ উদ্যোগে বিদেশে গিয়ে কাজ বা আয়ের পথ খোঁজা মানুষদের বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানোয় দেশের কী লাভ হলো, সংশ্লিষ্টদের কাছে এ প্রশ্নের জবাব চাই। যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম, তারা সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য যাচ্ছিলেন, তাতে কার কী ক্ষতি? এ কাজ বা এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতটুকু আইনসম্মত, সে প্রশ্ন তো আছেই। মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী, যারা তাদের শ্রম, ঘাম ও কষ্টের টাকায় আমার দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সহায়তা করছেন, সেসব রেমিট্যান্স যোদ্ধার সঙ্গে বিমানের কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার, তাদের প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলার অভিযোগ সর্বজনবিদিত। বিদেশ থেকে আসার সময় তাদের সবসময় নিজ দেশের বিমানবন্দরে আতঙ্কিত থাকতে হয়। যাত্রী হয়রানির কারণে মানুষ যদি বাংলাদেশ বিমানকে বর্জন করে, তাতে দেশের যে ক্ষতি হবে সে দায় কার? আইনের ছাত্র হিসাবে বলতে পারি, ভুক্তভোগীদের এক্ষেত্রে আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ধরনের হঠকারী ও খামখেয়ালিপূর্ণ কাজের জন্য ভুক্তভোগীরা সেটা যদি করেন, এর দায় কার? এতে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার যে লোকসান হবে, তার দায় কে নেবে? অথচ বিমানের শীর্ষ পর্যায়ে এবং বিমান পরিচালনা পরিষদে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা আছেন। এমনকি বিমান প্রতিমন্ত্রীকে আমরা একজন করিৎকর্মা ব্যক্তি হিসাবেই জানি। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত এ বিমান সংস্থার যথেষ্ট সুযোগ ছিল সেবার মান উন্নয়নের মাধ্যমে যাত্রীসেবা দেওয়ার। ৩. স্মরণে আছে, আশির দশকের শেষে আমার ছাত্রাবস্থায় নিজ জেলার এক বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই ইনভাইটেশন লেটার বা নিমন্ত্রণপত্র আনিয়ে প্রায় বছরব্যাপী সময় ধরে জেলার শতাধিক তরুণ-যুবককে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিলেন। মনে আছে, ওই সময় জেলা শহরে এ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি ও বেশ আলোচনা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে স্থায়ী হওয়া ওই সময়ের বেশ কয়েকজনকে আমি চিনি। তাদের মধ্যে অন্তত তিনজনকে জানি, যাদের একজন বাংলাদেশে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সদস্য ছিলেন। আরেকজন রপ্তানি উন্নয়ন প্রক্রিয়া এলাকায় শিল্প স্থাপন করেছেন, অন্যজন যুক্তরাষ্ট্রে আয়কর পরামর্শক হিসাবে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়া ওই ব্যক্তিরা নানাভাবে উভয় দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন। অনুৎপাদনশীল খাতে চাকরিরত এবং যাত্রীদের তথা জনগণের করের পয়সায় ভাতা নেওয়া এই বিমান কর্মচারীরা দেশের জন্য কতটুকু অবদান রাখছেন, আমি জানি না। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে কারও ভালো বা উন্নতি সহ্য করতে না পারা অথবা কাউকে বিপদে ফেলে বিশেষ আনন্দ বা তৃপ্তি পাওয়া একশ্রেণির অসুস্থ মানসিকতার লোক আছে, যাদের পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সমস্যা রয়েছে। ৪. উন্নত দেশগুলোর এমন পররাষ্ট্রনীতি বা অভ্যন্তরীণ নীতি আছে, যার দ্বারা তারা আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দেশে অভিবাসী গ্রহণ করতে এবং আশ্রয় দিতে পারে বা দিয়ে থাকে। এভাবে কানাডাও বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লোক নেওয়া ছাড়াও বর্তমানে ভ্রমণ ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে উদার নীতি গ্রহণ করেছে। এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ স্থায়ী অভিবাসন গ্রহণ করা ছাড়াও ভ্রমণ ভিসায় কানাডায় যাচ্ছেন। এ সুবিধা নিয়ে অনেক ভিসাধারী সেদেশে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে বা ভিসার স্ট্যাটাস বা ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে ভ্রমণ ভিসাকে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা বা কর্ম ভিসায় রূপান্তরিত করছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্থান প্রথম দশটি দেশের মধ্যেও নেই। সুতরাং বলা যায়, অভিবাসী গ্রহণে অথবা ভ্রমণ ভিসা প্রদানে তাদের কোনো সমস্যা না থাকলে আমাদের তো সমস্যা থাকার কোনো কারণ নেই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, নিজ দেশে লাখ লাখ বিদেশি যে অবৈধভাবে বসবাসসহ কাজ করে যাচ্ছে, সেটা ঠেকাতে না পারলেও অন্য দেশে যেন অবৈধ প্রবেশ ঠেকানোর মিশনে নেমেছি আমরা! কানাডা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর অভিবাসনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, শতাব্দীকাল ধরে অনুন্নত, উন্ননশীল বা উন্নত দেশ থেকে সেখানে যারা স্থায়ী হয়েছেন, তারা সবাই শতভাগ বৈধ প্রক্রিয়ায় সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেননি। সহজ কথা হলো, রাজনৈতিক বিপদসংকুল অবস্থায় পড়া বা আশ্রয়হীন ব্যক্তিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া সেসব দেশের নীতি ও আইনের অংশ। সে দেশগুলোর মানবিক সমাজের মানুষদের এর পক্ষে অবস্থানও সুস্পষ্ট। অন্যদিকে আমাদের বিমান সংস্থার এমন সিদ্ধান্ত শুধু কানাডার ঢাকাস্থ ভিসা ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষের কাছেই নয়, বহির্বিশ্বেও আমাদের দেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে সব ধরনের ভিসা প্রার্থীদের ভিসাপ্রাপ্তির বিষয়টিও পড়বে ঝুঁকির মধ্যে। পিডিশন প্রধান : সভাপতি, বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরাম