ভোটের লড়াইয়ে তৃতীয়-চতুর্থ বর্তমান অনেক চেয়ারম্যান


পরপর দুবারের উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ। পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। চেয়ারম্যান পদে এবারও নেমেছিলেন ভোটযুদ্ধে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়েছেন চতুর্থ। হারের কারণ জানতে চাইলে বলেন, দলের অনেক নেতাকর্মীর অসহযোগিতার কথা। কম ভোটার উপস্থিতি আর ভোট চাইতে জনগণের কাছে না যেতে পারার কথাও বলেন তিনি। তবে তার সঙ্গে একমত নন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। ঠিকাদারিসহ সব কাজে তার বিরুদ্ধে আত্মীয়করণের অভিযোগ করেন তারা। শুধু আব্দুল আজিজই নন, উপজেলা নির্বাচনে এবার গণহারে হারছেন বর্তমান চেয়ারম্যানরা। মন্ত্রী-এমপিদের সমর্থনেও হচ্ছে না কাজ। ভোট যুদ্ধে তৃতীয়-চতুর্থ পর্যন্ত হচ্ছেন কেউ কেউ। দলীয় প্রতীক না থাকায় ভোটাররা এবার নির্বিঘ্নে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারায় এমন হচ্ছে বলছেন অনেকে। ৮ মে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন। ওইদিন ভোট হয় বরিশাল বিভাগের ৪ উপজেলায়। বরিশালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রাজনীতির মাঠের অপরিচিত মুখ অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আব্দুল মালেক। অথচ এখানে নেপথ্যে ভিন্ন দুজনকে সমর্থন দিয়েছিলেন সিটি মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত ও বরিশাল সদর আসনের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম। বাকেরগঞ্জ উপজেলাতেও ঘটে অপ্রত্যাশিত ঘটনা। জায়ান্ট প্রার্থী কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা মতিউর রহমান বাদশাকে হারিয়ে দেন স্থানীয় রাজনীতির নতুন মুখ রাজীব তালুকদার। এখানে নেপথ্যে বাদশাকে সমর্থন দেন স্থানীয় এমপি হাফিজ মল্লিক। পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদায় পাবর্ত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির অনুসারীদের সমর্থন পান রাজীব। এই দুই উপজেলার কোনোটিতেই এবার নির্বাচন করেননি বর্তমান চেয়ারম্যানরা। ১ম ধাপে পিরোজপুরের ৩ উপজেলায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও চমক দেখান ভোটাররা। সদর উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান খালেক এবার নামেননি ভোটে। তার জায়গায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সাবেক মন্ত্রী শ.ম. রেজাউল করিম এমপির অনুসারী এসএম বায়জিদ। নাজিরপুরে ভোটে জেতেন এমপি রেজাউলের ছোট ভাই নূরে আলম সিদ্দিকি শাহিন। অবাক করা ঘটনা ঘটে পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলায়। এখানে জয় তুলে নেন সাবেক এমপি একেএমএ আউয়ালের ঘনিষ্ঠ জিয়াউল আহসান গাজী। বর্তমান চেয়ারম্যান মতিউর রহমানের অবস্থান দাঁড়ায় তৃতীয়। ২১ মে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও অব্যাহত থাকে ভোটারদের ভোট বিপ্লব। ঝালকাঠী জেলার নলছিটি উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তসলিম উদ্দিন চৌধুরীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় নানা সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি আমুর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত হয় বরিশালে। নির্বাচন শেষে দেখা যায় ভোটে হেরেছেন তার প্রার্থী তসলিম চৌধুরী। জিতে গেছেন আরেক আওয়ামী লীগ নেতা সেলিম খান। একই ঘটনা ঘটে বরিশালের মুলাদী উপজেলায়। হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত পরপর দুবারের উপজেলা চেয়ারম্যান তারিকুল হাসান মিঠু হারেন নবাগত জহিরউদ্দিন খসরুর কাছে। হিজলায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান টিপু সিকদারকে হারিয়ে দেন আলতাফ মাহমুদ দীপু। সম্পর্কে সহোদর টিপু-দীপুর পরিচিতি হাসানাতপন্থি হিসাবে। সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ড. শাম্মির সমর্থনও পান দীপু। হেরে যান এই আসনের এমপি পঙ্কজ দেবনাথের সমর্থন পাওয়া নজরুল ইসলাম রাজু। সাবেক চেয়ারম্যান টিপু সিকদারের অবস্থান দাঁড়ায় তৃতীয়। ভোলা সদর ও বোরহাউদ্দিন উপজেলায় হেরে যান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ এমপির ঘনিষ্ঠ সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ও আবুল কালাম। তার ভায়রা বোরহানউদ্দিনের বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালামের অবস্থান দাঁড়ায় তৃতীয়। সাধারন মানুষের এই ভোট বিপ্লবে আরও নানা নজির সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণের বিভিন্ন উপজেলায়। বরগুনার বেতাগী উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকান ভোটে হয়েছেন চতুর্থ। উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগে টানা ৫ বার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘দলের অনেকে বেইমানি করেছে। তাছাড়া কালোটাকার কাছে হেরেছি আমি।’ যদিও তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, চেয়ারম্যান হয়ে দলের নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে চলতে শুরু করেন তিনি। ঠিকাদারিসহ লাভজনক কাজে শুরু হয় তার আত্মোন্নয়ন প্রকল্প। পটুয়াখালীর গলাচিপায় উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান মু. শাহিন শাহ হেরে যান মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ওয়ানা মারজিয়া মিতুর কাছে। গলাচিপার পৌর মেয়র তুহিন খলিফার বোন মিতুর এই বিজয়কে সেখানকার স্থানীয় রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে দেখছেন সবাই। কেননা সেখানকার এমপি শাহজাদা সাজুর সমর্থনও ছিল শাহিনের দিকে। একইভাবে বাউফলে হেরেছেন বর্তমান চেয়ারম্যান দলের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব হাওলাদার। বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, বিএনপিবিহীন এ নির্বাচনে লড়াইয়ের সব প্রতিযোগীই আওয়ামী লীগের। তবে দলীয় প্রতীক আর সমর্থন না থাকায় ভোটাররা প্রার্থী পছন্দ করার সুযোগ পাচ্ছেন। তাছাড়া এবারের নির্বাচনে যে সবাই ভোট দিতে পারছে এটাও কিন্তু একটা বড় ব্যাপার। বর্তমান চেয়ারম্যানদের হারের বিষয়ে তিনি বলেন, ভোট আর ভোটের লড়াই না থাকলে প্রার্থী বাছাইয়ে লবিং-তদবির-আত্মীয়তা হয় প্রধান বিবেচ্য। বিগত সময়ে সেটাই হয়েছে। যে কারণে হয়তো যোগ্য প্রার্থীর হাতে যায়নি প্রতীক। এবার প্রতীক আর দলীয় সমর্থন না থাকায় ভোটাররা বুঝে শুনে ভোট দিচ্ছে। যে কারণে হারছে তারা। বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. আফজাল হোসেন বলেন, দল আর দলীয় প্রতীক না থাকায় ভোটাররা পছন্দের প্রার্থী বেছে নিতে পারছে। এখানে এমপি-মন্ত্রীদের পর্যন্ত নিষেধ করা হয়েছে কাউকে সমর্থন বা কারও পক্ষে কাজ করতে। প্রতীক থাকলে দলের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে। সেটা না থাকায় ভোটারদের মতামতেরই প্রতিফলন ঘটছে। বর্তমান চেয়ারম্যানদের পরাজয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলীয় সমর্থন পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে না পারার কারণেই তারা হেরে যাচ্ছেন। এখানে আমি কোনো অস্বাভাবিকতা দেখছি না।