মধ্যবিত্তের প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি কম


নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে সংসার খরচ বাড়ছেই। এই পাগলা ঘোড়া কোথায় গিয়ে থামবে, কে থামাবে, তা জানতে বাজেটের দিকে চোখ ছিল অনেক মধ্যবিত্তের। চেয়েছিলেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে। ভেবেছিলেন-নির্বাচন উপলক্ষ্যে হয়তো জনতুষ্টির কথা ভেবে অর্থমন্ত্রী নিত্যপণ্যের দর কমাতে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে হতাশ করেছেন। তিনি শুধু আশার বাণীই শোনালেন; কিন্তু রূপরেখা দিলেন না। উলটো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের চাপে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ব্যাপক হারে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের ওপর করারোপ করেছেন। তাতে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার মাধ্যমে মধ্যবিত্তকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতায় মুদ্রাস্ফীতির কারণে করদাতাদের প্রকৃত আয় হ্রাস পাওয়ায় করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব করে তিনি বলেন, এতে ব্যক্তি করদাতাদের করভার লাঘবের ফলে তারা নিয়মিতভাবে কর পরিশোধে আরও উৎসাহিত হবেন বলে আশা করা যায়। বাজেটে মধ্যবিত্তের প্রাপ্তি শুধু এটুকুই। অবশ্য ন্যূনতম আয়করের পরিমাণ আগের মতোই রাখা হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরশেন এলাকার করদাতাদের পাঁচ হাজার, অন্য সিটি করপোরশেন এলাকার করদাতাদের চার হাজার এবং অন্য জেলা শহর ও পৌর এলাকার করদাতাদের তিন হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। অবশ্য মধ্যবিত্তদের করভার লাঘবে ধনীদের সারচার্জ বা সম্পদ করে ছাড় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী! তাতে মধ্যবিত্ত কীভাবে লাভবান হবেন, তা বোঝা যায়নি। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, বিত্তশালী ব্যক্তি করদাতাদের কাছ থেকে নিট সম্পদের ভিত্তিতে সারচার্জ আদায় করা হয়। বিগত কয়েক বছর ধরে বিধানটি কার্যকর আছে। ব্যক্তি করদাতাদের সারচার্জ সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। সারচার্জ আহরণের বিধান পরিপালন সহজ করতে এবং মধ্যবিত্তদের করভার লাঘবে সারচার্জের ন্যূনতম সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেন তিনি। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট হারে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী যেমন: কলম, তৈজসপত্র, রূপচর্চাসামগ্রী, রান্নার এলপি গ্যাস, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে স্বর্ণালংকার, বাড়ি নির্মাণসামগ্রী সিমেন্টের দাম বাড়বে। কলম উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। এতে লেখার কলমের দাম বাড়তে পারে। আবাসিকে গ্যাস সংকট থাকায় এখন এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে সেখানে নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এলপি গ্যাস উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সিলিন্ডার বানানোর কাজে ব্যবহৃত স্টিল ও ওয়েল্ডিং ওয়্যার আমদানিতে শুল্ক আরোপ হয়েছে। এ কারণে এলপি গ্যাসের দাম বাড়তে পারে। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পণ্যের ভ্যাট বাড়ালে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবেই। কারণ, চূড়ান্তভাবে ক্রেতাকেই ভ্যাটের ভার বহন করতে হয়। হোক সে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত। ভ্যাট হার না বাড়িয়ে ফাঁকি বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া গেলে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যেত। এতে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়ে চাপ পড়ত না। তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে আয়করে প্রচেষ্টা থাকা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। রাত-দিন বা অবসরে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে চা-কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে বাদ দেওয়াই ভালো। কারণ, সিগারেট ও চা-কফিমেটের দাম বাড়বে। রাজস্ব আয়ের সহজ পন্থা হিসাবে প্রতি অর্থবছরই সিগারেটের মূল্যস্তর বাড়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাই বাজারে সিগারেটের প্যাকেটের দাম বাড়বে। চা-কফি সুস্বাদু করতে কফিমেট দরকার হয়, সেটি আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। তাই পণ্যটিরও দাম বাড়ার আশঙ্কা আছে। বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল, এটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। একইভাবে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালিসামগ্রী ও তৈজসপত্রের ভ্যাটহার বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে প্লাস্টিকের থালাবাসন, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িপাতিলের দাম বাড়তে পারে। মাইক্রোওয়েভ ওভেনের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে বিধায় বিদেশি ওভেনের দাম বাড়তে পারে। সুস্থ থাকতে অনেক মধ্যবিত্ত খেজুর, বাদাম খান; সেখানেও হাত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন বাড়াতে কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। তাই আমদানি করা কাজুবাদামের দাম বাড়তে পারে। এছাড়াও ফল-বাদাম আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি শুল্ক ফাঁকি রোধে তাজা ও শুকনা খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে খেজুরের দাম বাড়ার আশঙ্কা আছে। আমদানীকৃত চিজ-দইয়ের দামও বাড়বে। অনেক মধ্যবত্তি শখের বশে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে প্রতিবছর মোবাইল ফোন কিনে থাকেন। রাজস্ব আদায় বাড়াতে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও সংযোজন পর্যায়ে মোবাইল ফোনের ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। তাই মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে। ঈদ-উৎসবে বা ছুটিতে ঘুরতে মধ্যবিত্তরা যানজট এড়াতে বিমানে দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যান। নতুন বাজেটে আকাশপথে দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে ২০০ টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে, এতদিন দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ কর দিতে হতো না। এতে ঘোরাঘুরির খরচা বাড়বে। এছাড়াও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান অনেকে, সেখানেও খরচ বাড়বে। কারণ, বাজেটে বিমান টিকিটের ওপর ভ্রমণ কর বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে স্থলপথে বিদেশ গমনে ৫০০ এবং নৌপথে ৮০০ টাকা কর দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। আকাশপথে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে ১ হাজার ২০০ টাকা কর ছিল, এটি বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। অন্য দেশ ভ্রমণে তিন হাজার টাকা কর ছিল, এটি চার হাজার টাকা করা হয়েছে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান, হংকং, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও তাইওয়ান ভ্রমণে যাত্রীপ্রতি চার হাজার টাকা ভ্রমণ কর ছিল, এটি বাড়িয়ে ছয় হাজার টাকা করা হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে খরচ বাড়ার পরও অনেকে টাকা জমিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য অথবা ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের কথা মাথায় রেখে স্বর্ণালংকার কেনার পরিকল্পনা করেন। নতুন বাজেটে স্বর্ণালংকারের দাম বাড়তে পারে। কারণ, ব্যাগেজ রুলে বড় সংশোধন আনা হয়েছে। আগে ভরিপ্রতি স্বর্ণের বার আমদানিতে ২ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হতো, এখন সেটি ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। তাও আবার একটির বেশি স্বর্ণের বার আনলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। এ কারণে চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকতে পারে। এতে স্বর্ণালংকারের দাম বাড়তে পারে। এত নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির কথা জেনে দুশ্চিন্তায় কপালে ঘাম এসে থাকলে টিসু দিয়ে মোছার কথা ভাবছেন নিশ্চয়ই। সেখানেও রেহাই নেই। বাজেটে সব ধরনের টিসুর দাম বাড়তে পারে। কিচেন টাওয়ালসহ টয়লেট টিসু, ন্যাপকিন টিসু, ফেসিয়াল টিসু/পকেটে টিসু ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল, এটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে টিসুর দামও বাড়তে পারে।